SkyIsTheLimit
Bookmark

মে দিবস রচনা


মে দিবসের তাৎপর্য
বা মে দিবস ও বর্তমান বিশ্ব

ভূমিকা : কাল নিরবধি। চির চঞ্চল মহাকালের পালা বদলের প্রভাব পড়ে মানুষের ভাবভাবনায়, সংস্কার, সংস্কৃতিতে, জীবন ও মূল্যবােধে। এভাবে সভ্যতা এগােয় সােপানের পর সােপান ডিঙিয়ে। কোন কোন বিশেষ দিন তার পূর্ব তাৎপর্যসহ অর্থমহিমা ভুলে নতুন তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে মানুষের কাছে পৃথক অর্থবহ হয়ে দাড়ায়। মে দিবসেরও এরকম অর্থ পরিবর্তনের একটা ছােট ইতিহাস আছে। ইউরােপ ভূখণ্ডে একসময় পহেলা মে উদ্যাপিত হত আনন্দ উৎসবে। মে বৃক্ষ রােপণ করে সাজানাে হত পুফপসম্ভারে। মে রাণীর কল্পনায় কবি লিখতেন কবিতা, আপামর সাধারণ থেকে রাজারাণী সকলে মেতে উঠতেন নাচে গানে, আমাদের হুল্লাড়ে। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এসে পহেলা মে নতুন তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে দেখা দিল বিশ্ববাসীর কাছে, হারিয়ে গেল পূর্ববর্তী মে দিবসের আনন্দ অনুষ্ঠানের ধারা। শতাব্দীকালের ঐতিহ্যমণ্ডিত মে দিবস আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসরূপে আজ বিশ্বের মেহনতী মানুষের কাছে অভিনন্দিত।

মে দিবসের ঐতিহাসিক পটভূমি : মে দিবসের ঐতিহাসিক পটভূমিকায় একদিকে আছে ধনগর্বী শাসক-শ্রেণীর নিষ্ঠুর পৈশাচিকতার প্রকাশ, অপরদিকে অসহায় শ্রমিক শ্রেণীর বুকের রক্ত ঢেলে ও ফঁাসির মধ্চে জীবনের জয়গান গেয়ে মহান আত্মােৎসর্গ। যন্ত্রনির্ভর শিল্পসমৃদ্ধির ফলশ্রুতিতে শ্রেণী বৈষম্যের উদ্ভব, যার দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থিত মালিক ও শ্রমিক গােষ্ঠী। শােষণে বঞ্চনায় শ্রমিকদের তিল তিল করে নিঃস্ব, রিক্ত, নিরন্ন করে একক পুঁজির পাহাড় গড়াই ধনতান্ত্রিক শাসনকাঠামােয় মালিক চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। আর শােষিত শ্রমিক শ্রেণী অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে অত্যাচার উৎপীড়নের প্রতিবাদ জানাতে, দাবি আদায়ের প্রয়ােজনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মিছিল ধর্মঘটে সামিল হতে বাধ্য হত। কলকারখানায় শ্রমিকদের শুধু উদয়াস্ত নয়, দিনের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আঠারাে থেকে কুড়ি ঘণ্টা কাজ করতে হত। এ অমানুষিক পীড়নের হাত থেকে অব্যাহতি পাবার উদ্দেশ্যে শ্রমিকের যে আন্দোলন, মে দিবসের স্মরণীয় ঘটনার পিছনের ইতিহাস সে কাজের ঘণ্টা কমানাের আন্দোলনের পরিণাম বিশেষ। কলেকারখানায় দৈনিক বাধ্যতামূলক কুড়ি ঘণ্টা কাজের সময়সীমাকে দশ ঘণ্টায় নামিয়ে আনার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয় উনবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ দশকে। তারপর আমেরিকার মাটিতে অনেক ঘটনাই সংঘটিত হয়। ট্রেড ইউনিয়ন রাজনৈতিক ভিত্তি লাভ করে,দাস প্রথার অবসান হয়, শিল্পের ব্যাপক প্রসারের সাথে পাল্লা দিয়ে শ্রমিক আন্দোলন দুর্বার হয়ে উঠে, 'আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার সংগঠিত হয়। উনবিংশ শতাব্দীর আটের দশকে শ্রমিকের কাজের সময় দিনে আট ঘণ্টা ধার্য করার স্বপক্ষে আইন প্রণয়নের দাবি নিয়ে আন্দোলনের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিদ্ধান্তে ঘােষিত ১৮৮৬ সালের পহেলা মে থেকে কোন শ্রমিকই দিনে আট ঘণ্টার বেশি কাজ করবে না।

ঐতিহাসিক মে দিবসের সূচনা : তারপর আসে সেই বহু কাঙ্ক্ষিত ঐতিহাসিক মে দিবস বা ১৮৮৬ সালের পহেলা মে। দিনে আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে প্রত্যক্ষ ধর্মঘটে সামিল হন পাঁচ লক্ষ শ্রমিক। কিন্তু শ্রমিকদের আন্দোলন ঠেকাতে পুলিশ হামলা চালায় শ্রমিকদের উপর। ৩রা মে পুলিশী হামলায় নিরস্ত্র ছ'জন শ্রমিক নিহত হন হার্ভেস্টার কারখানায়। পরের দিন হে মার্কেট স্কোয়ারে সমবেত প্রতিবাদ সভায় পুলিশ গুলি চালালে নিরস্ত্র শ্রমিকের বুকের রক্তে রঞ্জিত হয় হাতের নিশান। চার শ্রমিক নেতা পাইজ, পার্সনস, ফিসার ও এঞ্জেল বন্দী হন এবং বিচারে তাঁদের প্রাণদণ্ড হয়। এ অবিচারের বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত প্রতিবাদে সােচ্চার হয়ে উঠে। বাস্তিল পতনের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠান উপলক্ষে আয়ােজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এ মর্মে প্রস্তাব গৃহীত হয় যে, ১৮৯০ সালের ১লা মে থেকে প্রতিবছর ১লা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মে দিবস নামে উদযাপিত হবে। বিগত ১৯৯০ সালের ১লা মেতে মে দিবসের শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশসহ বাংলাদেশে মে দিবস পালন : ১৮৯০ সালেই গ্রেট ব্রিটেনের হাইড পার্কে সমবেত লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের সভায় মে দিবস পালিত হয়। আমেরিকায় পালিত হয় আট ঘণ্টা কাজের দাবি নিয়ে ধর্মঘটের মধ্যস্থতায়। ফান্সে সংঘটিত হয় মে দিবসের মিছিল, পরে রাশিয়া, চীন, জার্মানিতে মে দিবস অনুষ্ঠিত হতে থাকে। ভারতে সূচনা হয় ১৯২৩ সালে মাদ্রাজে, উদ্যোগী ছিলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের হােতা সিঙ্গাভেলু চেটিয়া। বাংলাদেশেও যথাযােগ্য মর্যাদার সাথে মে দিবস পালিত হয়। এভাবে বিশ্বের যেখানে যত মেহনতি শ্রমিক মানুষ আছেন, তাঁরা শ্রমিকের এ সংগ্রাম, সংহতি ও সৌভ্রাতৃত্বের প্রতীক মে দিবস স্মরণে প্রতিবছর ১লা মে আন্তর্জাতিক মে দিবস পালন করছেন।

মে দিবসের তাৎপর্য : মে দিবস শ্রমিক দিবস। শ্রেণী বৈষম্যের অবসানের লক্ষ্যে সংকল্পবদ্ধ হবার দিবস, মালিকের শােষণ ও বঞ্চনা, অত্যাচার, অবিচার, উৎপীড়ন থেকে মুক্তির স্বপক্ষে অঙ্গীকারবদ্ধ হবার দিবস। দুনিয়ার মেহনতি মানুষ এ পুণ্যদিনটিতে রক্তরঞ্জিত লাল নিশানের প্রতীক লাল ঝান্ডার তলে দাঁড়িয়ে আপােসহীন সগ্রামের শপথ গ্রহণ করেন। সংগ্রামের ঐক্য প্রেরণায় উজ্জীবিত হন।

উপসংহার : মে দিবস শ্রমিকের সংগ্রামী জীবনের দিক নির্দেশক, শ্রেণী বৈষম্যের দাসত্বমুক্তির অনুপ্রেরক। ধনতান্ত্রিক নিষ্ঠুর শাসনের নিগড়ে আজও বিশ্বের বৃহত্তর জনগােষ্ঠী পিষ্টমথিত। সােভিয়েত রাশিয়া ও পূর্ব ইউরােপের দেশগুলাের সমাজতান্ত্রিক শাসন ও সমাজব্যবস্থা পতনের পর মেহনতি শ্রমজীবী মানুষের মনে বিশ্বজুড়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নভঙ্গের হতাশা নিরাশা তাদের মনকে সংশয়াচ্ছন্ন করেছে। তা সত্ত্বেও মে দিবসের পুণ্যলগ্নে শ্রমিকের বুকের রক্তে রাঙানাে পতাকার তলে দাড়িয়ে বিশ্বের মেহনতী মানুষ আজও ধনতন্ত্রের দাসত্ব থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখে, সংগ্রামের শপথ নেয়, সৌভ্রাতৃত্বের অঙ্গীকার গ্রহণ করে। মে দিবস তাদের মনের আকাশপটে জেগে থাকে অভ্রান্ত ধ্রুবতারার মত দিক নির্দেশক ও পথ প্রদর্শক হয়ে।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment