SkyIsTheLimit
Bookmark

একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মকথা রচনা

মুক্তিযােদ্ধা ও বাংলাদেশ
বা মুক্তিযোেদ্ধর প্রতিদান

ভূমিকা : ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। আমি তখন বি. এ. সমাপনী বর্ষের ছাত্র। সামনেই পরীক্ষা, কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে লেখাপড়ায় মন বসাতে পারছিলাম না। সারাদেশ জুড়ে তখন চলছিল অসহযােগ আন্দোলন, বন্দীদশা থেকে মুক্তির আন্দোলন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে টালবাহানা শুরু করে। এ অবস্থায় বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বজ্রকণ্ঠে ঘােষণা করেন, "এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করতে হবে।” এরপর অগ্নিঝরা ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা পত্র পাঠ করেন। ডাক আসে মুক্তিযুদ্ধের। আমাদের গ্রাম থেকে আমি এবং আবু দায়েন হাজির হই গিয়ে ভারতের আগরতলায়। ট্রেনিং নিয়ে চলে আসি আড়াই হাজার থানায়, যােগ দিই অন্যান্য মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে।

ডিউটি বণ্টন ও শত্রুদের শক্তি সম্পর্কে জানার চেষ্টা : তখন ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিক। থানা কমান্ডার আবদুস সামাদ পরিকল্পিতভাবে নতুন করে আমাদের ডিউটি ভাগ করে দিলেন। আমাদের কয়েকজনের ডিউটি পড়ল আড়াই হাজার থানার পাঁচরুখী অঞ্চলে। এখানে পাকবাহিনীর একটা বড় ধরনের ঘাঁটি ছিল। প্রথমে আমরা অবস্থান নিলাম পাঁচরুখী বাজার থেকে প্রায় এক মাইল দূরে দুপ্তারা উচ্চ বিদ্যালয়ে। দু'দিন ধরে আমরা চারদিকের খোঁজখবর নিলাম। তারপর একদিন গভীর রাতে অগ্রসর হলাম বাজারের দিকে। বাজার থেকে প্রায় আধ মাইল দূরে আমরা অবস্থান নিলাম। বেশ কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে প্রথমে আমি একবার রাইফেলের ট্রিগার টিপলাম। একটা ফায়ার হল। অমনি বাজারের দিক থেকে ফায়ার হতে থাকল। আমরা চুপ হয়ে থাকলাম। আমাদের উদ্দেশ্য, একটা ফায়ার করে দেখা, শত্রুদের দিক থেকে কি পরিমাণ ফায়ার হয় এবং অনুমান করা, তারা সংখ্যায় কত? তাদের শক্তি পরীক্ষা করাই আমাদের প্রথম এবং প্রধান কাজ। আমার প্রথম ফায়ারের পর বাজার থেকে প্রায় শতেক দেড় শ ফায়ার হল তবে থেমে থেমে। মনে হল তারা সংখ্যায় বেশি নেই। ফায়ার হচ্ছে একটা বা দুটি রাইফেল থেকে। কোন অটোম্যাটিক অস্ত্রের ফায়ার শােনা যাচ্ছে না।

শত্রুদের নির্মূল করার উদ্দেশ্যে অগ্রসর : এ অবস্থায় আমরা আবার অগ্রসর হলাম পাঁচরুখী বাজারের দিকে। উদ্দেশ্য বাজার ঘেরাও করে পাকবাহিনীকে আক্রমণ করা। বাজারের খুব কাছাকাছি গিয়ে চারদিকের অবস্থা পরখ করে নিলাম। তখনও শত্রু বাহিনীর গুলি থেমে যায়নি। কয়েক মুহূর্ত পর পর রাইফেলের গুলির শব্দ হচ্ছিল। রাত প্রায় শেষের দিকে প্রয়ােজনীয় পরিকল্পনা সাজিয়ে আমি কুলিং করে বড় রাস্তার উপরে উঠতেই চোখে পড়ল একটা গাড়ির হেড লাইটের আলাে। নেমে এলাম ব্যাংকারে, গাড়িটি নরসিংদী থেকে আসছিল। সঙ্গে সঙ্গে আমি রাস্তার সামান্য ঢালুতে নেমে গেলাম। একটা আর্মি জীপ এসে থামল ব্যাংকারের পাশে। সংখ্যায় তারা আট জন। আমি নিশ্চিত যে, আমার মৃত্যু অতি নিকটে। কিন্তু হলে কি হবে, আমার তখন মনে পড়ে গেছে ট্রেনিং শেষে হাতে অস্ত্র তুলে নেয়ার মুহূর্তে শপথ নিয়েছিলাম দেশের জন্য মাতৃভূমির মুক্তির জন্যে জীবন দিতে কুণ্ঠাবােধ করব না। একথা মনে পড়ার সাথে সাথে মৃত্যুর কথা ভুলে, দেশের স্বাধীনতার কথাই আমার কাছে বড় হয়ে উঠল। পাগলের মত ফায়ার করে শত্রুবাহিনীর সব কটাকে খতম করলাম।

শত্রুসেনাদের একজনকে হত্যা এবং আমার ডানহাত গুলিবিদ্ধ : সামনের দিকে এগােচ্ছি হঠাৎ সামনে একটা দালান দেখতে পেলাম। দালান থেকে ফায়ার হচ্ছিল, আমি তার পেছন দিক দিয়ে অবস্থান নিলাম। তখন ভাের হয়ে আসছিল। ক্রুলিং করে দালানের পেছন দিকের দরজার কাছে উপস্থিত হলাম। দরজার একটা ফুটো পেয়ে উকি দিলাম ভেতরে। লক্ষ্য করলাম, একজন পাক সেনা সারা দেহে একটা কম্বল জড়িয়ে মাথা উঁচু করে ফায়ার করছে রাইফেল দিয়ে। গুলির শব্দে এমন ভাবে সে মগ্ন হয়ে আছে যে, কোন দিকে তার খেয়াল নেই। সাথে সাথে আমি মাথা নামিয়ে আমার রাইফেলের নলটি তুলে ধরলাম ফুটো বরাবর পাক সেনাটির মাথা বরাবর নিশানা ঠিক করে ট্রিগার টিপে দিলাম। ফায়ার হওয়ার পরমুহূর্তে একবার শব্দ হল আহ’। তার পর সরে এলাম সামান্য পেছনের দিকে, ল্যাঞ্চার দিয়ে দরজা গুড়িয়ে দিলাম। দেখলাম, পাক সেনাটা একা একা পড়ে আছে ভিতরটায়। আশপাশে ভালভাবে পরখ করে ঢুকলাম ভেতরে। গুলি খাওয়া পাক সেনাটা ছাড়া আর কেউ নেই। তখনও সে মরেনি। পুবের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে লােকজনের ভীড় জমে গেছে। একটা জীপ আসছিল নরসিংদীর দিক থেকে। থামল না। ব্রাশ ফায়ার করতে করতে চলার গতি অব্যাহত রাখল। আমি আমার আবেগ ধরে রাখতে পারলাম না। জীপের চাকা ফুটো করার জন্য ফায়ার করতে চাইলাম। ততক্ষণে একটা গুলি এসে বিদ্ধ হল আমার ডান হাতের বাহুতে। জীপটা চলে যাওয়ার পর আমার সঙ্গীরা তাড়াতাড়ি আমাকে নিয়ে হাজির হল স্থানীয় চিকিৎসালয়ে। আমার ডান হাতের বাহু থেকে নিচের অংশ কেটে ফেলা হল। কিছুক্ষণ পর সুস্থ হয়ে উঠলাম। কিন্তু আমার একটা হাত আর আমার দেহের অংশ হিসেবে থাকল না।

স্বাধীনতা লাভ : দেশ স্বাধীন হল। কিন্তু আমার আর বি. এ. পরীক্ষা দেয়া হল না। পূরণ হল না আমার মা-বাবার আশা। আমি এখন পঙ্গু। আমি জানি, আমার হাতের মূল্য কেউ দিতে পারবে না। শুধু আমার কেন; অগণিত মুক্তিযােদ্ধা যারা দেশের জন্যে কেউ পা, কেউ হাত, কেউ চোখ এবং জীবন দিয়েছেন তাদের মূল্য কেউ দিতে পারবে না।

উপসংহার : আজ মুক্তিযুদ্ধের অনেকগুলো বছর পরও স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠে অনেক স্মৃতির মালা। আজ আমার বেঁচে থাকার কথা ছিল না। তবু বেঁচে আছি। দু চোখ ভরে দেখছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে। তবে যে চেতনা নিয়ে বাংলার কৃষক শ্রমিক, ছাত্রজনতা মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল, হাতে হাত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জীবন বাজী রেখে মাতৃভূমি থেকে শত্রুবাহিনীকে বিতাড়িত করেছিল, তাদের সে চেতনা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে সেকথা আজ না-ই বা বললাম। তবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য শুধু ভূখণ্ডগত স্বাধীনতাই ছিল না। ছিল একটা সুখী সমৃদ্ধ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করা।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment