SkyIsTheLimit
Bookmark

রচনা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৬ বছর; প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

ভূমিকা: ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় হয় নতুন একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের। কিন্তু বাংলাদেশের এ স্বাধীনতা সহজে অর্জিত হয়নি। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও রক্তের বিনিময়েই কেবল সম্ভব হয়েছে এই স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার জন্য লাখ লাখ মানুষ যেমন প্রাণ দিয়েছে তেমনি হাজার হাজার মা-বােনকে হারাতে হয়েছে সম্রম। তাই বলা যায় দেশের আপামর জনতা অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সেদিন মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, স্বাধীন করেছিল দেশ। সঙ্গত কারণেই স্বাধীনতার পর জনগণের প্রত্যাশা ছিল অনেক। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, সেসব মহান লক্ষ্য দেশের জনতাকে মুক্তির সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিল পরবর্তীকালে তার অধিকাংশই ভূলুষ্ঠিত হয়েছে। জনগণ আজও পায়নি প্রকৃত মুক্তির স্বাদ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ:  আদর্শ বলতে সাধারণত কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য, উদ্দেশ্য বা দর্শনকে বােঝায়। এটি একটি আবেগের বিষয়। কোন। বিশেষ আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েই মানুষ তার পথ পরিচালনা করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে যেসব আবেগ ও উচ্ছ্বাস সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল এবং সাহস যুগিয়েছে দুর্বার আন্দোলন সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়তে তাই সমষ্টিগতভাবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ এক যুগান্তকারী ঘটনা। এর রয়েছে সুদীর্ঘ পটভূমি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় তা চরম রূপ ধারণ করে ১৯৭১ সালে। বীর বাঙালি দল-মত-নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গড়ে তােলে দুর্বার প্রতিরােধ আন্দোলন। পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর বৈষম্য ও অত্যাচার থেকে মুক্তি ও স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। সুদীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের ফলে পরাজিত হয় পাক হানাদার বাহিনী এবং বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তাই স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে তা একটি আলােচনার বিষয়। নিচে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করা হলাে
রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম আদর্শ বা লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ। প্রক্রিয়ায় অধিক হারে বাঙালিদের অংশগ্রহণ। জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তৃত্বই ছিল সর্বাধিক। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানিরা বিপুলভােটে জয়লাভ করলেও তারা প্রকৃত ক্ষমতার স্বাদ কখনাে পায়নি। আর এসব জাতীয় বৈষম্য থেকে মুক্তির লক্ষ্যে বাঙালি জনতা সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করে। ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাঙালিরা অর্জন করে। গণতন্ত্রের মুক্তি: আধুনিক বিশ্বের আদর্শ শাসন ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র ব্যাপকভাবে সমাদৃত। কেননা গণতন্ত্রের মাধ্যমে জনগণের মতামতের সঠিক প্রতিফলন সম্ভব। পাকিস্তান শাসনামলে জনগণ প্রকৃত গণতন্ত্রের স্বাদ কখনােই পায়নি। তাই গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বিকাশ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও বাংলাদেশ আজও তার কাজিত গণতান্ত্রিক শাসনের মুখ দেখতে পায়নি। গণতন্ত্রের ছদ্মরণে এখনাে পরিদৃষ্ট হয়েছে একদলীয় ও স্বৈরাচারী শাসন। গণতন্ত্রের নীতি আদর্শ হয়েছে ভূলুণ্ঠিত, পদদলিত। 
রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ রোধ: পাকিস্তানি রাজনীতির ললাটে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ একটি কলঙ্কিত অধ্যায়। ক্ষমতালিক্দু পাক সামরিক জান্তারা রাজনৈতিক অঙ্গনকে বারবার করেছে কলুষিত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা ছিল রাজনীতিকে সামরিক বাহিনীর প্রভাব মুক্ত করা। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কতিপয় সেনা সদস্য কর্তৃক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে সে চেতনা ধূলিস্যাৎ করে দেয়। জেনারেল জিয়া ও এরশাদের ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়া নিয়মতান্ত্রিক ছিল না। তাছাড়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায়ও সামরিক বাহিনী কলকাটি নাড়ে। সুতরাং বলা যায়, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পূর্ণরূপে সামরিক হস্তক্ষেপ মুক্ত হতে পারেনি।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা লাভ: বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পূর্বে এ দেশের মানুষ স্বাধীনভাবে নিজেদের মত প্রকাশ করতে পারতাে না। সংবাদপত্রের কোনাে স্বাধীনতা.ছিল না। মত প্রকাশের স্বাধীনতা তাই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম একটি আদর্শ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা বিদ্যমান। 
বাঙালি জাতীয়তাবাদ: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম আদর্শ ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ। কিন্তু ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তন সে সম্ভাবনাকে তিরােহিত করে। ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা থেকে সেটা পৃথক সংবিধানের পঞ্চদশ সংশােধনের মাধ্যমে আবার বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ধর্মনিরপেক্ষতা পরিহার: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সকল ধর্মের মানুষ একাত্ম হয়ে অংশগ্রহণ করেছিল। পাকিস্তানের সংবিধানে ইসলাম ধর্মের স্বীকৃতি ছিল বিশেষভাবেই। ফলে সংখ্যালঘু শ্রেণি সর্বদাই একধরনের হীনমন্যতায় ভুগত। স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বিজয় লাভ এরূপ অবস্থা পরিবর্তনের একটা আবহ তৈরি করেছিল। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জিয়া ও জেনারেল এরশাদের বেসামরিকীকরণ প্রক্রিয়া ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে। বিশেষ করে জেনারেল এরশাদ সংবিধানের অষ্টম সংশােধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘােষণা করে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে দেশ থেকে করেছেন বিতারিত ‌। 
স্বকীয় পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ: বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এর রয়েছে সম্মানজনক অবস্থান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম আদর্শ ছিল স্বকীয় মর্যাদাভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ  স্বাধীনতা-উত্তর সকল সরকার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে এই মৌল আদর্শই অনুসরণ করে আসছে। ফলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলকথা হতে পেরেছে সকলের সাথে বন্ধুত্ব কারও সাথে শত্রুতা নয়।
দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গঠন: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম আদর্শ ছিল প্রশাসনের সকল পর্যায় থেকে দুর্নীতির মূলােৎপাটন। পাকিস্তানি প্রশাসন ব্যবস্থা ছিল আগাগােড়াই দুর্নীতিতে আকীর্ণ। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের ৪৬ বছর পরও বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন কায়েম করতে পারেনি। বরং অনেক ক্ষেত্রে তা শাখা-প্রশাখাসহ এক মহীরূহ হিসেবে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ কয়েক বছর পূর্বেও দুর্নীতিতে বিশ্বে প্রথম স্থান অধিকারী দেশ ছিল। আর সব ধরনের দুর্নীতির সুতিকাগার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বাংলাদেশের নিম্নমানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, যা মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে করেছে ম্লান। 
সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়ন:  স্বাধীনতার পূর্বে অর্থনৈতিক অঙ্গনে পূর্ব পাকিস্তান ছিল চরম বৈষম্যের শিকার। পূর্ব পাকিস্তান পরিণত হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ ও শিল্প কারখানার প্রধান কাঁচামাল যােগানদাতার। ফলে অর্থনৈতিকভাবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্য ছিল পর্বতসম। মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূলেই ছিল অর্থনৈতিক শশাষণমুক্তি ও উন্নতি কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৬ বছর পরও আমরা দেখি, পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক শােষণ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়েছে সত্য, কিন্তু সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি থেকে গেছে সুদূরপরাহত। সমাজে উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্য এখনাে আকাশ-পাতাল
বৈষম্যমুক্ত সামাজিক কাঠামাে: পাকিস্তান শাসনামলে সামাজিক কাঠামাে ছিল চরম বৈষম্যমূলক। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি প্রভৃতির ওপর পরিকল্পিতভাবে আঘাত হানতে থাকে। পাকিস্তানের অধিকাংশ লােকের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও উর্দুকে সমগ্র পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘােষণা করা হয়। তাছাড়া বাঙালিদের সকল ক্ষেত্রে হেয় করার একটা নগ্ন প্রবণতা লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল এসবের তীব্র প্রতিবাদ। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সমাজকাঠামাের বৈষম্য খুব একটা চোখে পড়ছে না।
উপসংহার: উপরিউক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দীর্ঘ পথপরিক্রমার ফলস্বরূপ। এর বীজ নিহিত সুদূর অতীতে। দীর্ঘ শাসন-বৈষম্য অবিচারকে বাঙালি জাতি কখনােই সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামও ছিল সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিবাদ। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, প্রভৃতি বৈষম্য অত্যাচারের-অন্যায়ের প্রতিবাদস্বরূপ। এক মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে রক্তাক্ত সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালি ছিনিয়ে আনে এ দেশের স্বাধীনতা। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পরও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শাবলি রয়ে গেছে চরম অবহেলায়। স্বাধীনতার এত বছর পরও যখন আমরা দেখি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বিশ্বে বারবার শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়, তখন সত্যিকার অর্থেই স্বাধীনতার মূল্য ভূলুষ্ঠিত হয়। দেশমাতৃকার টানে সেদিন যেসব তাজা প্রাণ শহিদ হয়েছিল তাদের আত্মা আজ নিশ্চয়ই আর্তচিৎকারে ফেটে পড়ছে। তাই দেশের সরকার, বিরােধী দলসহ সকলের প্রচেষ্টা হওয়া উচিত দেশের সর্বক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শগুলাের বাস্তবায়ন; তবেই সার্থক হবে ২ লাখ মা-বোেনের ইজ্জত এবং ৩০ লাখ শহিদের আত্মদান।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment