শিক্ষা সফর কেন : শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চার দেয়ালের মধ্যে প্রথাগত শিক্ষার আদান-প্রদান সীমাবদ্ধ। কিন্তু শিক্ষায়তনের বাইরে পড়ে আছে বিচিত্র জগৎ। আকাশভরা সূর্যতারা, বিশ্বভরা প্রাণ, দেশে দেশে কত- না নগর রাজধানী। কত না নদী গিরি-সিন্ধু-মরু। কত অজানা জীব, অপরিচিত তরু। আছে বিচিত্র মানুষ আর তাদের বিচিত্র জীবন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণীকক্ষে গৃহীত পাঠে এ জীবনের খবর থাকতে পারে। কিন্তু তা উপভােগ্য ও অভিজ্ঞতালব্ধ করার জন্য বাইরে আসা দরকার। বাইরে আসাই শিক্ষা সফর। সুদূরকে জানা, অচেনার রহস্য উঘাটন, অপরিচিতের সঙ্গে পরিচয় সাধন --এসব বিষয় মনকে আকৃষ্ট করে। গতানুগতিক, সংকীর্ণ জীবনের নিরানন্দ পরিবেশে থেকে মুক্তিলাভের জন্য ভ্রমণের সুযােগ আছে। ভ্রমণের মধ্যে দিয়ে শিক্ষা পূর্ণতা পায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা যে পাঠ গ্রহণ করে তা বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ। ইতিহাস, ভূগােল, সাহিত্য পাঠ্যপুস্তকে সীমাবদ্ধ। তা মুখস্ত করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ডিগ্রি সনদপত্র লাভ করে শিক্ষার্থীরা। পরীক্ষার জন্য যেটুকু প্রয়ােজন সেই সংকীর্ণ সীমানায় দৃষ্টি নিবন্ধ থাকে, বিষয়ের সুবিস্তৃত পরিসরে শিক্ষার্থীর দৃষ্টি প্রসারিত হয় না। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য জ্ঞানের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ বলে পরীক্ষা পাশের পড়া দিয়ে সে লক্ষ্য অর্জিত হয় না। শিক্ষায় আসে না পূর্ণতা।
সফরের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক : শ্রেণীকক্ষের শিক্ষার মধ্যে পূর্ণতা আনার জন্যই শিক্ষা সফর। দেশভ্রমণের সঙ্গে তার কিছু পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। দেশভ্রমণের সঙ্গে তার কিছু পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। দেশভ্রমণে আনন্দ আছে, সেই সঙ্গে আছে। শিক্ষা। নিছক দেশ দেখে বেড়ানাের মধ্যে আছে। তাতে শিক্ষার কিছু না থাকলেও চলে। কিন্তু শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্য নিয়ে যে ভ্ৰমণ তার সঙ্গে আনন্দ থাকতে পারে। তবে সে আনন্দই প্রধান নয়, শিক্ষাই সেখানে প্রধান। সােনারগাঁয়ে আছে ঐতিহাসিক নিদর্শন। স্বাধীন বাংলার সম্রাটেরা সােনারগাঁয়ে যে গৌরবময় ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন। তা সেখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে যত স্পষ্টভাবে অবহিত হওয়া যায় তা আর কোথাও পাওয়া যায় না। ময়নামতিতে আছে সুদূর অতীতের বৌদ্ধ যুগের ঐতিহাসিক নিদর্শন। ইতিহাসের একজন ছাত্র যখন ময়নামতির বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষের পাশে হেঁটে বেড়ায় তখন অতীতের সেই স্মৃতিচিহ্নগুলাে সেখানে মুখর হয়ে ওঠে। বইয়ের কালাে অক্ষরে তা উপলব্ধি করা যায় না। বগুড়ার মহাস্থানগড়েও রয়েছে ঐতিহাসিক নির্দশন। সেখানকার প্রতিটি ধুলিকণা যেন অতীতের ঘটনাবলির বাস্তব ও মৃর্তমান সাক্ষী। এসব জায়গায় শিক্ষা সফর করা হলে শিক্ষার্থীরা যেই সেই সূদুর অতীত থেকে বেড়িয়ে আসে। শুধু যে ঐতিহাসিক স্থানের সঙ্গে শিক্ষা সফরের সম্পর্ক তা নয়। আরও বহুবিধ বিষয়ের জন্য শিক্ষা সফরের গুরুত্ব আছে। ফরাক্কা যে ভয়াবহ সর্বনাশ নিয়ে আসছে বাংলাদেশের জন্য, যে বিশাল এলাকাকে মুরুভূমিতে পরিণত করছে। দেশের উত্তরাঞ্চলে গেলে তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় লাভ করা যাবে। মেঘনার করাল গ্রাসে হাতিয়ার একদিকে ভাঙছে, অপরদিকে বিশাল চর জেগে উঠছে তা নিজের চোখে না দেখলে বােঝার উপায় নেই। সেন্ট মার্টিন বা নিঝুম দ্বীপে সংগ্রামশীল মানুষ কীভাবে নিজেদের জীবিকার্জনের সাধনায় রত চোখে না দেখলে তার পূর্ণাঙ্গ উপলদ্ধি অসম্ভব। আর সুন্দরবনের সেই সমুদ্র উপকূলের হিরণ পয়েন্টে প্রকৃতি তার বন, হরিণ, বাঘ, কুমির, সাগর সৈকত নিয়ে কি বিস্ময়কর খেলায় মেতে আছে তা বইয়ের পাতায় যথাযথ পাওয়া যাবে না। দেখতে হলে যেতে হবে সেই হিরণ পয়েন্টে। অর্থনীতি আর বাণিজ্যের ছাত্ররা যায় আদমজীতে, পলাশে, আশুগঞ্জে, চট্টগ্রামের শিল্প-কারখানায় বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য। দেশে কাগজ, সিমেন্ট, গ্যাস ইত্যাদি উৎপাদনের প্রক্রিয়া দেশে যে বাস্তব জ্ঞান অর্জিত হয় তা শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ মূল্যবান। বাংলাদেশে অচিরে কয়লা আর কঠিন শিলা আহরিত হবে। এভাবে বহু বিচিত্র বিষয়ে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হয়। শিক্ষা সফর এসব কারণে বিশেষ গুরুত্বে দাবিদার।
অন্যান্য দিক : শিক্ষা সফরের মাধ্যমে অধীত্ব বিষয়ের জ্ঞানকে ব্যাপকতর করা ছাড়াও এর আরও উপকার আছে। সফরের মাধ্যমে মনের ক্ষুদ্রতা, তুচ্ছতা দূর হয়, মনে আসে মানবিকতার মহৎ আদর্শ। সফর মানুষে মানুষে প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি করে। পার্বত্য এলাকার বিভিন্ন উপজাতির বৈচিত্র্যময় জীবনের সঙ্গে সমতলের অধিবাসীদের যদি সহজ মেলামেশা থাকত তাহলে সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া, কঠিন ছিল না। ছাত্ররা শিক্ষা সফরে গিয়ে নিজেদের দেশকে নিবিড়ভাবে জানবে, দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে পরিচিত হবে এবং তাদের প্রতি মমত্ববােধ উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা দেশকে সুন্দর করে গড়ে তােলার উদ্যোগ নিবে। সফর বা ভ্ৰমণের আকাঙ্খা না থাকলে জ্ঞানের পরিধি সীমিত হয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা শুধু নিজেদের গড়ে তােলার জন্যই প্রস্তুতি গ্রহণ করবে না, তারা যাতে জাতিকে কিছু দিতে পারে সেজন্য ভবিষ্যতে কাজ করতে হবে। দেশকে, দেখে, দেশকে জেনে, দেশের মানুষকে ভালবেসে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ভবিষ্যতের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হবে।
শিক্ষা সফরের প্রক্রিয়া : শিক্ষা সফরের গুরুত্ব বিবেচনা করে শিক্ষাবর্ষের কর্মসূচির সঙ্গে তার সমন্বয় সাধন করা দরকার। বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা সফরের সম্পর্ক। ইতিহাসের ছাত্র আর অর্থনীতির ছাত্রের সফরের জায়গা এক হবে না। সেজন্য নিজ প্রয়ােজনে স্থান নির্বাচন করতে হবে। এসব সফর সাধারণত দলীয়ভাবে সম্পাদিত হয়। লেখাপড়ার ফাকে অথবা কোন ছুটিতে শিক্ষা সফরের পরিকল্পনা করা যেতে পারে। বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বুঝে সফরের মেয়াদ নির্ধারণ করা যায়। উপযুক্ত সময়ও নির্ধারিত করতে হবে। শিক্ষা সফরের জন্য দরকার তহবিলের। প্রতিষ্ঠান থেকে বা ব্যক্তিগত চাদায় সে তহবিল গঠন করা যায়। শিক্ষা সফরে গাইড বা নির্দেশক হিসেবে শিক্ষক দায়িত্ব নেবেন।
উপসংহার : শিক্ষা সফরকে শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। শিক্ষা শুধু মুখস্থ বিদ্যার সাহায্যে পরীক্ষা করাই শিক্ষার লক্ষ্য। শিক্ষা সফরের মাধ্যমে পাঠ্যক্রমের পরিপূরক জ্ঞানার্জন সম্ভব। শিক্ষা সফরের মাধ্যমে জানা যায় দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, জাতীয় জীবনের বৈশিষ্ট্য, উপভােগ্য হয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, লাভ করা যায় মানুষের সঙ্গ। শিক্ষা সফরে আছে দেশকে নানা দিক থেকে জানার, দেশের সমৃদ্ধি ও সম্ভাবনা সম্পর্কে অবিহত হওয়ার সুযােগ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ গঠন -পাঠনে শিক্ষার বিশাল ব্রীপ্ত সম্ভভ হয় না। পাঠ্য গ্রন্থের শিক্ষা নীরস ও তথ্য ভারাক্লান্ত হয়ে পড়ে। শিক্ষাকে প্রাণবন্ত, আকর্ষনীয় ও বাস্তবানুগ করার জন্য শিক্ষামূলক ভ্রমণের বিকল্প নেই। শ্রেণীকক্ষের শিক্ষা বাস্তব ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় শিক্ষা সফরের মাধ্যমে। শ্রেণী শিক্ষার পরিপূরক হিসেবে শিক্ষা সফরের অভিজ্ঞতা কাজে আসে। শিক্ষাকে জীবনমূখী ও বাস্তবানুগ করার জন্য শিক্ষা সফরের প্রচুর সুযােগ সৃষ্টি করা দরকার।
Post a Comment