SkyIsTheLimit
Bookmark

রচনা নারী শিক্ষা বিস্তারে উপবৃত্তি

নারীশিক্ষা বিস্তারে ছাত্রী উপবৃত্তি 
বা নারীশিক্ষা বিস্তারে উপবৃত্তির ভূমিকা
ভূমিকা : দেশের অর্থ-সামাজিক উন্নয়নে শিক্ষার কোনাে বিকল্প নেই। পৃথিবীর উন্নত জাতিসমূহের দিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যায় যে, তাদের উন্নতির মূলে রয়েছে শিক্ষার প্রভাব। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশ যে আজো বিশ্বের দরিদ্রতম দেশসমূহের অন্যতম, তার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসরতা। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার অভাবেই আমাদের সামাজিক প্রগতি এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। সরকার অবশ্য শিক্ষার উপযােগিতা ও গরুত্বকে উপলব্ধি করে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ সরকার সামগ্রিক শিক্ষা বিস্তার কর্মসূচিরই একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ হচ্ছে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রী/মেয়েদের জন্য উপবৃত্তির প্রচলন।
বাংলাদেশের সামাজিক পটভূমিতে নারীশিক্ষা : বাংলাদেশ একটি দরিদ্র দেশ। এ দেশ নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে এখনাে মুক্ত হতে পারে নি। এর প্রদান কারণ, সামাজিক ক্ষেত্রে হীন দৃষ্টিভঙ্গি, কসংস্কার এবং অর্থনৈতিক বাধা। ফলে দেশের সর্বজনীন শিক্ষা বিস্তার সরকারের প্রচেষ্টা সুফল বয়ে আনতে পারছে না। প্রচলিত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা হয় না, যদিও দেশের মােট জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। তাদেরকে শিক্ষা বিস্তার কার্যক্রমের মূল ধারার সাথে যুক্ত করা না গেলে সর্বজনীন শিক্ষার লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে না। নারীশিক্ষার বিস্তার তাই দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের প্রচেষ্টারই অংশ। বাংলাদেশে বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৬২.৬৬ শতাংশের কাছাকাছি বলে দাবি করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নারীদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ২৬ শতাংশের উর্ধ্বে নয়। তাই জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থেই শিক্ষাক্ষেত্রে নারী-পুরুষের এ বৈষম্য দূর করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
সরকারের শুভ চেতনা : আমাদের পুরুষতাত্ত্বিক সমাজে সকল ক্ষেত্রে পুরুষরাই এগিয়ে। পারিবাকিরভাবে একজন ছেলেশিশুকে শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর করারা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়ে শিশুদেরকে কোন মতে বড় করে পাত্রস্থ করাকেই পিতামাতা অগ্রগণ্য দায়িত্ব বলে মনে করে। ফলে মেয়েশিশুরা প্রাথমিক বিদ্যালয় যাওয়ার সুযোগ কম পায়। যারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায়, তারাও আবার পারিবারিক উদাসীনতা কিংবা বিশেষ করে অর্থনৈতিক কারণে মাধ্যমিক স্তরের বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযােগ পায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পিতামাতা মেয়েদের শিক্ষা বলতে নাম ঠিকানা লিখতে পারাটাকেই যথেষ্ট বলে মনে করে। সরকার আথ-সামাজিক এ অবস্থাটিকে আমলে নিয়ে নারীদের জন্য শিক্ষার সুযােগ অবারিত করার লক্ষ্যে শুভ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। শিশুদের পড়ালেখা যাতে অর্থিক কারণে বন্ধ না হয়ে যায়, সেজন্য সরকার মেয়েদেরকে উপবৃত্তি প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে।
নারীর সামগ্রিক উন্নয়নে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ:  বাংলাদেশে মেয়েদের উপবৃত্তি করছে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নারীদের অধিকার সামগ্ৰিকি অবস্থার উন্নয়নকল্পে গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগ। জাতিসংঘের প্রত্যক্ষ সহযােগিতায় নারী ক্ষমতায়ন ও সামগ্রিক উন্নয়নকল্পে ইতােমধ্যে চারটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষে বেইজিং নারী সম্মেলনের ঘােষণায় নারীমুক্তির যে সনদ প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বাংলাদেশও স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ ঘােষিত নারী উন্নয়ত কৌশলের সাথে ঐক্যমত্য পােষণ করায় জাতিসংঘসহ বিশ্বব্যাংক , আইডিবি, এডিবি প্রভৃতি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং দাতাসংস্থা ও বাংলাদেশ নারীশিক্ষা বিস্তারে আর্থিক সাহায্য প্রদানে সম্মত হয়। আন্তর্জাতিক সাহায্য ও সরকারের সদিচ্ছার পরিপ্রেক্ষিতে নারীশিক্ষা বিস্তারে বহুমুখী পদক্ষেপের অংশ হিসেবে গৃহীত হয় মেয়েদের উপবৃত্তি কর্মসূচি। 
মেয়েদের উপবৃত্তি কর্মসূচির প্রচলন : দাতা সংস্থাসমূহের নিকট থেকে অর্থ সাহায্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তায় ১৯৯৬ সালে তৎকালীন সরকার ছাত্রী উপবৃত্তি চালু করে। এ প্রকল্পের আওতায় প্রাথমিক শিক্ষার পর নিম্নমাধ্যমিক শ্রেণী থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত মেয়েদের বেতন মওকুফ করা ছাড়াও ভর্তি ফ্রি , রেজিস্ট্রেশন ফি ও পরীক্ষা ফি প্রদানের জন্য ব্যাংকের মাধ্যমে নির্দিষ্ট হারে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়। ছাত্রীদেরকে মাসে ৪০ টাকা হারে বৃত্তি ছাড়াও বই কেনার জন্য ২৫০ টাকা করে এককালীন আর্থিক সাহায্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। 
উপবৃত্তি সম্প্রসারণ : সরকার ছাত্রী উপবৃত্তিকে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত সম্প্রসারণ করে। এর ফলে মেয়েদের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা গ্রহণে অনুকূলে পরিবেশ সৃষ্টি হয়। বেতন মওকুফ ছাড়াও সরকার বই কেনা, ভর্তি ফি, রেডিস্ট্রেশন, ফি, পরীক্ষা ফি বাবদ ছাত্রীদেরকে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে সর্বসাকুল্য ৩ হাজার ৩ শ টাকা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এতে নারীর ক্ষমতায়ন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে তাদের মুক্তি এবং সামগ্রিকভাবে জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা সংযােজিত হয়েছে। 
উপবৃত্তির ব্যয় ও সুবিধাভােগী ছাত্রী : উপবৃত্তির আওতায় মােট ৫টি প্রকল্পে সরকার বছরে প্রায় ৪৫ লাখ ছাত্রীকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০০৩-০৪অর্থবছরে ৪টি খাত থেকে সুবিধা ভােগী ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৩৯ লক্ষ। ২০০৪-০৫ অর্থবছরে এ খাতে সরকার মােট ৫টি প্রকল্পে বরাদ্দ দিয়েছে ২০৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশের মতাে দরিদ্র দেশের জন্য এ পরিমান অর্থ অবশ্যই বিপুল। সরকারের এ বিপুল অর্থের সদ্ব্যবহার হলে জাতির কল্যাণ নিশ্চিত হবে। 
উপবৃত্তির সুফল : নারীসমাজ মােট জনসংখ্যার অর্ধেক। তাদের উন্নতি ছাড়া জাতীয় উন্নয়নের কল্পনা করা বৃথা। সেজন্য সরকার সামগ্রিকভাবে জাতীয় উন্নয়নের উপায় হিসেবে নারীশিক্ষার প্রসারকে গ্রহণ করে গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছে। গত কয়েক বছরে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ছাত্রী সয়খ্যা উল্লেখযােগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্রছাত্রী ভর্তির অনুপাত ৪৭ ৫৩। উপবৃত্তির সুফল হিসেবে বাল্যবিবাহের হারও হ্রাস পেয়েছে। আগে প্রাথমিক শিক্ষার পরই গ্রামের দরিদ্র ও অসচেতন পিতামাতা যেখানে মেয়েদের পাত্রস্থ করতে উদগ্রীব হয়ে পড়তাে আজ তারা মেয়েদেরকে সাহসের সাথে স্কুলে পাঠাচ্ছে। স্কুল পর্যায়ের শিক্ষা সমাপ্ত করে ছাত্রীরা উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্য কলেজে ভর্তি হচ্ছে। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাই নারীদের অংশগ্রহণ এখন আশানুরূপ বৃদ্ধি পেয়েছে। নারীশিক্ষার বিস্তার তথা নারীদেরকে দেশের উন্নয়নে সম্পৃক্ত করতে সরকার ভবিষ্যতে স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত উপবৃত্তি চালুর চিন্তা-ভাবনা করছে। 
উপবৃত্তি নিয়ে দুর্নীতি : সাম্প্রতিককালে পত্র-পত্রিকায় বিশেষভাবে মাধ্যমিক পর্যায়ের উপবৃত্তির অর্থ নিয়ে দুর্নীতির নানা অভিযােগ উন্ধাপিত হচ্ছে। একই শিক্ষার্থীকে একাধিক স্কুলে ভর্তি দেখিয়ে সরকারি অর্থ তসরুফের অভিযােগ অনেক। তাছাড়া পড়ালেখা করে না এমন মেয়েদেরকে স্কুলে ভর্তি দেখিয়ে দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বৃত্তি প্রাপ্তির জন্যে যেসব শর্ত আরােপ করা হয়েছে, সেগুলাের প্রতিও ভুক্ষেপ করা হয় না। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলাে, এসব দুর্নীতির সাথে কতিপয় দুর্নীতিপরায়ণ শিক্ষক ও স্কুল-কলেজ পরিচালনা কমিটির কর্তাব্যক্তিরা জড়িত। শিক্ষা বিভাগের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীও দুর্নীতির উর্ধ্বে নয়। ফলে সরকারের মহৎ চেষ্টার সুযােগে অনেক ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। 
কর্মসুচির সাফল্যের জন্যে করণীয় : সরকারের এ মহতী উদ্যোগকে সফল করে তােলার জন্যে সর্বপ্রথম সংশ্লিষ্ট দুর্নীতির উর্ধ্বে উঠতে হবে। স্কুল পর্যায়ে ছাত্রী উপবৃত্তি নিয়ে দুর্নীতির অভিযােগ সবচেয়ে বেশি। শিক্ষা বিভাগের তদারককারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আন্তরিক হলে এ দুর্নীতি রােধ করা সম্ভব। সেই সাথে শিক্ষক মহলকে নিজেদেরকে সম্মান ও মর্যাদার প্রতি সুবিচার করে সামান্য অর্থের বিনিময়ে নৈতিকতা সিবর্জন না দেওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। অপরদিকে সরকারকে বৃত্তির পরিমাণ কিছুটা বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হতে হবে। কেননা, শিক্ষা উপকরণের মূল্য যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে অনেক দরিদ্র পিতামাতার পক্ষেই বৃত্তির উপর নির্ভর করে সন্তানের পড়ালেখা চলিয়ে নেওয়া সমভব নয়। 
উপসংহার : মেয়েদের উপবৃত্তি কর্মসূচী সরকারের একটি অতি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কতিপয় দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযােগ সত্ত্বেও এ কর্মসূচির জন্য সরকারি সদিচ্ছাকে সাধুবাদ জানাতেই হবে। সরকারের এ প্রশংসনীয় উদ্যোগকে সফল করার জন্যে সচেতন মহলেরও সহযােগিতার প্রয়ােজন রয়েছে। বিশেষ করে সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ সরকারি অর্থের যথাযথ ব্যবহার আন্তরিক হলে কর্মসূচি অধিকতর ফলপ্রসূ হবে। তবে সরকার এ বৃত্তি স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত করলে নারীর উচ্চশিক্ষা ও ক্ষমতায়নেরক্ষেত্রে অধিকতর সুফল অর্জন সম্ভব হতাে।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment