বা জ্ঞান আহরণে আনন্দ
বা জ্ঞানের জন্য বই পড়া
ভূমিকা : মানসিক অস্থিরতা থেকে নিবৃত্তি পাওয়ার ঐকান্তিক ইচ্ছা সর্বজনীন। কেননা, মানসিক অস্থিরতায় মানুষের সামগ্রিক জীবনটাই হয়ে যায় ভারসাম্যহীন। যার জন্য কর্মময় জীবন হয় কণ্টকাকীর্ণ। এ নাজুক অবস্থা হতে পরিত্রাণ পাওয়ার সর্বপ্রধান মাধ্যম হিসেবে মনীষীরা বই পড়াকেই চিহ্নিত করেছে। তবে এ ব্যাপারে নানা জন নানা মত পােষণ করে থাকে। কেননা কেউ খেলাধুলা, কেউ গানবাজনা, কেউ তাস, পাশা ও জুয়া খেলেও আত্মতৃপ্তি লাভ করে। তবে পুস্তক পাঠের আনন্দের মত অনাবিল আনন্দ অন্য উপকরণে অনুপস্থিত। বই পড়ার প্রয়ােজনীয়তা : মানব মনের একটা স্বতঃসিদ্ধ অভিপ্রায় হল অজানাকে জানা। প্রকৃতির এ লীলা নিকেতনে নানা আনন্দ, রহস্য ও বেদনাবিধুর ঘটনার সম্যক ধারণা পাওয়া সহজসাধ্য নয়। তবে যাদের মনে রয়েছে উদ্বিগ্ন বাসনা, সমস্ত কিছু জ্ঞাত হওয়ার প্রয়ােজনে দেশ ভ্রমণই শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। কিন্তু প্রত্যেকের বেলায় তার পরিপূর্ণতা আসে না। সে হিসেবে সহজ মাধ্যম স্বরূপ তাকে আসতে হয় বইয়ের সান্নিধ্যে। কেননা, বই-ই ক্ষণিকের মধ্যে সমস্ত বিষয় সম্বন্ধে অবহিত করাতে সক্ষম। তদুপরি তাতে রয়েছে আনন্দের বারিধারা।
পুস্তক পাঠের তাৎপর্য : গ্রন্থ পাঠ মানব মনে সৃষ্টি করে নীতি, সহানুভূতি, স্নেহ, মায়ামমতা, ভক্তি , প্রেমপ্রীতি ও ভালোবাসা, বীরত্বের মহত্ববােধ, সুন্দরের সাধনা, ত্যাগের দীক্ষা আনয়নে গ্রন্থের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মনীষীরা জীবনকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে জীবনের আসল রহস্য সন্ধান করে তা তারা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন পুস্তর্কর কালাে অক্ষরে। পুস্তক পাঠ মানুষের মনে আনে আনন্দ বেদনার কাব্যিক ও দার্শনিক সত্যবােধ। পুস্তক পাঠের আনন্দ সম্ধন্ধে লিখতে গিয়ে রাশিয়ার ম্যাক্সিম বলেছেন, “আমাদের মধ্যে যদি উত্তম বলে কিছু থাকে তার জন্য আমরা বইয়ের কাছেই ঋণী।” মানুষের সংঘাতময় জীবনের মধ্যে সামান্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার মাধ্যম হিসেবেও পুস্তক পাঠকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সে পরিপ্রেক্ষিতে সাহিত্যিক এয়াকুব আলী চৌধুরী বলেছেন, "সাহিত্য অমৃতায়মান শক্তির উৎস। শক্তি কল্পফলের রস। তাই এ চির আদি ব্যাধি বিজড়িত কর্মতাপ তপ্ত নিরাশা তুহিনাচ্ছন্ন সংসারে জাতি এটা পান করে মরণ তন্দ্রার মধ্যে বেঁচে উঠে।
অবসরের সঙ্গী : শিশু, কৈশাের ও যৌবনকাল অতিক্রান্ত হওয়ার পর মানুষ প্রায় নিস্তেজ ও অকর্মণ্য হয়ে যায়। বার্ধক্যজনিত জরা ব্যাধিতে সে খুবই অসহায় ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। এ নিঃসঙ্গ মুহূর্তে একমাত্র একটা বই-ই তাকে বন্যায় ভাসিয়ে দিতে পারে। তাই কবি ওমর খৈয়াম কাব্য স্পর্শে সংজ্ঞালুপ্তির পথে পাড়ি জমাতেন। তিনি বলতেন, "নেশায় মৌনতা শিথিলতা লাভ করবে, কিন্তু অমর কাব্য সাথে থাকবে অনন্ত যৌবন সাক্ষীর প্রতীক রূপে।”
দায়িত্ব ও সচেতনতা বােধ : আনন্দের আতিশয্যে ডুবে থাকার তাগিদেই শুধু মানুষ পৃথিবীতে আসে নি। আল্লাহর শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবেও তার কিছু করণীয় রয়েছে। তার উপর নীতিগত অর্পিত দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে সম্যক ধারণা সে গ্রন্থ থেকেই অর্জন করতে পারে। সে দৃষ্টিকোণ থেকে ইংরেজ সাহিত্যিক ভিনসেন্ট বলেছেন, When we buy a book we buy pleasure. উক্ত বাক্যে এটাই পরিস্ফুট হল যে, বই পড়ে আমরা আনন্দের অংশটাই বেশি উপভােগ করি।
পুস্তক পাঠে আনন্দ : পুস্তক পাঠের মাধ্যমে সমস্ত সৃষ্টি সম্বন্ধে আমরা কম বেশি অবগত হতে পারি। যে মানুষ বই পড়ে সে মুক্ত কণ্ঠে বলতে পারে মুক্ত করহে সকল বন্ধু যুক্ত করহে সবার সাথে। আমরা অবনীন্দ্রনাথের "বুড়াের আংলাে" গ্রন্থটি পড়লে সে কল্পিত সুবচনী হাসের ডানায় চড়ে বাংলাদেশের জলাভূমি থেকে সুন্দর হিমালয়ের মানষ সরােবর অবধি এক রােমান্টিক ভ্রমণের সুমহান আনন্দ লাভ করতে পারি। আমরা আমেরিকান উপন্যাসিক আর্ণে হেমিণ্ড য়ে রচিত The old man and the Sca উপন্যাসটি পড়লে বৃদ্ধ সেন্টিয়াগাের করুণ জীবনের কথা জেনে অভিভূত হই। এসব গল্প পড়ে শান্তির অমিয় স্পর্শ লাভ করি তা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।
উল্লেখযােগ্য বই : পাঠকের যেমন রুচি এবং দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা আছে, তেমনি বইয়েরও ভিন্নতা আছে। সব পাঠক এক মনের নয়, আবার সব বইও এক ধরনের নয়। গল্প, কবিতা, ছড়া, উপন্যাস, নাটক, ভ্ৰমণ কাহিনী, বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা, দুঃসাহসিক কাহিনী ইত্যাদি নানা প্রকার বই নানা ধরনের পাঠকদের প্রচুর আনন্দ দিয়ে থাকে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কবিতার বইগুলাে পাঠকদের কাছে খুবই সমাদৃত। এগুলাের মধ্যে সােনার তরী, বলাকা, মানসী, গীতাঞ্জলি খুবই উল্লেখযােগ্য। তাঁর গল্পগুলােও পাঠকের কাছে খুব প্রিয়। এছাড়া তাঁর উপন্যাস 'শেষের কবিতা 'চোখের বালি, চতুর্গ', ‘চার অধ্যায়’, ‘নৌকাডুবি’, ‘দুইবােন’ আধুনিক পাঠকদের মনেও প্রচণ্ড সাড়া জাগায়। কাজী নজরুল ইসলামের অগ্নিবীণা', বিষের বাঁশি, 'দোলন-চাঁপা 'ছায়ানট', 'সিন্ধু হিন্দোল’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থগুলাে পাঠকদের খুব প্রিয়। এছাড়া তাঁর 'রিক্তের বেদন’, ‘ব্যথার দান’ ও ‘মৃত্যুক্ষুধা' উপন্যাস খুবই সুখপাঠ্য। অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'শ্রীকান্ত', 'দেবদাস', মেজদিদি, 'বিরাজ বৌ ,"দত্তা', পথের দাবি, চরিত্রহীনা, দেনাপাওনা', 'গৃহদাহ ইত্যাদি উপন্যাস একালের পাঠকদেরকে সমানভাবে আন্দোলিত করে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী’, ‘অশনি সংকেত’; হুমায়ূন আহমদের 'নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার; শাহরিয়র কবিরের একাত্তরের যিশু প্রভৃতি অসংখ্য বই পাঠকদের আনন্দ দিতে সক্ষম।
উপসংহার: গ্রন্থ পাঠের মূল্য বা মান নির্ণয় সম্পর্কে ও মানসিক দিক দিয়ে আমরা আজও পশ্চাতে। জগতের সভ্যজাতিরা যেখানে বই পড়ায় নিমগ্ন সেখানে আমরা ব্যস্ত আছি অন্ন সংস্থানের চিন্তায়। তবুও বাংলা সাহিত্যে বাংলাদেশের স্থান সপ্তমে। এটা গৌরবের বিষয়। পাঠকের আনন্দ প্রদানের জন্য চণ্ডিদাস, বিদ্যাপতি প্রমুখের অবদান এ ব্যাপারে বিবেচনা প্রসূত।
Post a Comment