বা স্বাধীনতা দিবস ও বাংলাদেশ
ভূমিকা : বাংলাদেশ আজ স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র। পৃথিবীর বুকে আমরা স্বাধীন জাতিরূপে চিহ্নিত। পৃথিবীর সব দেশ ও জাতিকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে। বুকের তাজা রক্ত দিতে হয়েছে। কিন্তু বিশ্বের বুকে যতই রক্ত বিপ্লব সংঘটিত হােক না কেন বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলন তার চেয়ে অধিক মহীয়ান ও গরীয়ান। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাস বাঙালি সূর্য সন্তান ও মিত্রবাহিনী একত্রিত হয়ে মরণপণ লড়াই করেছে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে। বাঙালির এ মরণপণ লড়াইয়ে প্রায় তিরিশ লক্ষ বাঙালি প্রাণ দেয় আর ৩ লক্ষ মা বান তা দের ইজ্জত হারায়। তাই এ স্বাধীনতা অমূল্য, এ স্বাধীনতা অতি পবিত্র।
বাঙালির সংগ্রামশীলতা : ১৯৭১সালের ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে পাক বাহিনীর আকস্মিক আক্রমণে স্তিম্ভিত হয় সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষ। নিরস্ত্র বাঙালির আর কোন উপায় ছিল না রক্তকে রক্ত দ্বারা প্রতিরােধ ছাড়া। আ সশস্ত্র সংগ্রামের পথ যার মূল লক্ষ্য স্বাধীনতা। ৯ মাসের দীর্ঘ রক্তাক্ত সংগ্রামের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হল। আর এ পথটিই ছিল বাঙালির এ সংগ্রামশীলতা ১৭৫৭ সালের পলাশীর প্রহসনের মধ্য দিয়ে সূচিত। সুদীর্ঘ দু'শ বছর ইংরেজদের শােষণের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষীয়দের সংগ্রাম চলেছে। তার পরিণতিতে ৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে দীর্ঘ ২৪ বছর শােষিত হয়। ৫২ সালে ভাষার জন্য প্রথম রক্তাক্ত আন্দোলন এবং ৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান যার দু'বছরের মধ্যে '৭১-এর রক্তাক্ত ইতিহাস রচিত হয় স্বাধীনতা যুদ্ধে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি : পশ্চিমা শোষকের হাতে দুই যুগের শােষণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিপন্নতার চরমে পৌছায়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালি পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেও ক্ষমতায় পেল না। ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য ইয়াহিয়া চক্র ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে এবং পূর্ব বাংলার জনগণের অর্থে কেনা অস্র SISTER BE- দিয়ে নিরীহ মানুষের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। অসংখ্য নরনারী নিহত হয়, ধর্ষিত হয়, লুপ্ঠিত হয় এবং অগ্নদাহে ঢাকা শহর মৃতের শহরে পরিণত হয়। “আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। এখন দখলদার বাহিনীকে বহিষ্কার করাই একমাত্র কাজ এবং এতে করে আসবে চূড়ান্ত বিজয়।” ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্সের ঐতিহাসিক ভাষণে বলেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।” দীর্ঘ সময়ের মরণপণ লড়াইয়ে বাংলাদেশ নবজন্ম লাভ করে বিশ্বের মানচিত্রে। মাটির মমতাভরা কণ্ঠে আমরা গেয়ে উঠলাম,
“আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি
এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী।”
স্বাধীনতা দিবস পালন : প্রতি বছর সময়ের পাখায় ভর করে আসা ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালিত হয়। এ দিনে আমরা স্মরণ করি আনন্দ বেদনার এক করুণ ইতিহাস। বীরের রক্তস্রোত, মাতার অশ্রুধারায় এ দিন ফিরে ফিরে আসে স্মৃতির বার্তা নিয়ে। আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি বাংলার বীর দামাল ছেলেদের।
"এক সাগর রক্তের বিনিময়ে
বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা
আমরা তােমাদের ভুলব না।"
এ স্বাধীনতা দিবসে আমাদের দুই চোখ অশ্রুসিক্ত হয়। শাণিত হয় হৃদয়ের তরবারি। স্বাধীনতা রক্ষার দৃপ্ত শপথ নেই। এদিন আমাদের আনন্দের দিন, বেদনার দিন, শােককে শক্তিতে রূপান্তর করার দিন।
"মৃত্যু যদি হয় হােক, তবু দাসত্ব নয় কভু"
প্রতি বছর ২৬ মার্চ এ বার্তা বয়ে আনে। দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি অফিস, শহর, নগর, বন্দর, গঞ্জ, গ্রাম, গ্রামান্তরে স্বাধীনতার পতাকা নীল আকাশের নিচে উড়তে থাকে।
আনুষ্ঠানিকতা : ঢাকার সাভারস্থ স্মৃতিসৌধে অতি প্রত্যুষে হাজার হাজার মানুষ দল বেঁধে লাখাে শহীদের উদ্দেশ্যে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। ২৫শে মার্চ রাত থেকেই অনুষ্ঠান শুরু হয় তােপধ্বনির মাধ্যমে। তাছাড়া নানাবিধ খেলাধুলা কুচকাওয়াজ, সভা অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শহীদদের আত্মার শান্তি কামনায় বিশেষ মােনাজাত করা হয়। রাতে বড় বড় ভবনে আলােকসজ্জা করা হয়। রাষ্ট্রপ্রধান জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। রেডিও, টেলিভিশন বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করে থাকে।
স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী : ১৯৯৭ সালের ২৬ মার্চ ছিল স্বাধীনতা লাভের পচিশ বছর। বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে এ বছর স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী পালন করা হয়। রজত জয়ন্তীতে সর্বস্তরের উৎসাহী জনতা একত্রিত হয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিবসটি পালন করে। মূল অনুষ্ঠান হয় সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে। যেখানে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ দেন সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় শিখা চিরন্তন এবং যে শিখা দ্বারা সেটাকে প্রজ্জ্বলিত করা হয় তা দীর্ঘ পথ পরিক্রমণ করে সারা বাংলাদেশ ব্যাপী। এ অনুষ্ঠানে বিদেশী অতিথি হিসেবে বিশ্বের তিন মহান নেতা যথাক্রমে প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতাকামী নেতা ইয়াসির আরাফাত, দক্ষিণ আফিকার প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট সােলেমান ডেমিরেল উপস্থিত হন। হাজারাে জনতার সমাবেশে ঐ দিন স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক শিখা চিরন্তন প্রজ্জ্বলিত হয়। এ শিখা আমাদের বীরত্বের অমরগাঁথার প্রাণশক্তি।
রজত জয়ন্তীতে স্বাধীনতার মূল্যায়ন : যে আশা-আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নকে সাথে নিয়ে ৩০ লাখ প্রাণ শহীদ হয় সে আশা-আকাঙক্ষা। হয়ত নানা কারণে পূরণ হয়নি। এ ব্যর্থতা আমাদেরই। আমাদের কাছে শহীদরা যে প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বিদায় নিয়ােছিল ৩া পূরণ করতে হলে আমাদের সব ভেদাভেদ ভুলে এক হয়ে কাজ করতে হবে। যেমন হয়েছিল ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করতে গিয়ে। যে স্বাধীনতা আমরা ঐতিহ্যসূত্রে পেয়েছি সে স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব দেশের আপামর জনসাধারণের। সময়ের পথ ধরে স্বাধীনতার আদর্শে বলীয়ান হয়ে দেশকে গড়ে তােলার দায়িত্ব পালন করতে হবে বহুমাত্রীয়।
উপসংহার : রক্ত সমুদ্রে ডুব দিয়ে শহীদরা যে ফুল আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিল তা আজ যুবক, পঁচিশ বছরে উত্তীর্ণ তাকে সঠিক দিক নির্দেশনার সময় এটাই। এটা না করতে পারলে আমাদের অঙ্গীকার ব্যর্থ হবে, শহীদের ষপ্ন বিলীন হবে। প্রতি বছর ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবস অনুষ্ঠান সর্বস্ব হয়ে পড়বে।
Post a Comment