SkyIsTheLimit
Bookmark

রচনা নৌকা ভ্রমণ

ভূমিকা :
সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা এ দেশের প্রাকৃতিক দৃশ্য বড়ই মনােরম। বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ বলে পরিচিত হলেও এ দেশে অনুভূত হয় সাধারণত শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা ঋতু। এদেশের বুকজুড়ে অসংখ্য নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর থাকায় বর্ষা ঝতুতে চারিদিকে থৈ-থৈ %3D পানি দৃশ্যমান হয়। আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল হলেও বছরের অধিকাংশ সময় এ দেশের বিরাট অংশ বর্ষার জলে নিমজ্জিত থাকে। বর্ষার পানিতে যখন সমস্ত প্রকৃতি পানিতে হাবুডুবু খায় সেরকম একসময়েই আমার জীবনে প্রথম নৌকা ভ্রমণের সুযােগ এসেছিল।
যাত্রার পূর্ব-প্রস্তুতি : কলেজে তখন পূজার ছুটি। এমন সময় আমাদের কাছের একজন বন্ধুর বােনের বিয়ে উপলক্ষে আমরা কয়েকজন বন্ধু আমন্ত্রিত হলাম। আমাদের বাড়ি থেকে তাদের বাড়ি যেতে প্রায় দশ কিলােমিটার পথ নৌকায় পাড়ি দিতে হয়। এ দীর্ঘ দশ কিলোমিটার পথ নৌকায় পাড়ি দিয়ে বন্ধুর বােনের বিয়েতে যােগ দেয়ার জন্যে আমরা সবাই পরিবারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে পাশের গ্রাম থেকে একটি মাঝারি সাইজের নৌকা ভাড়া করলাম। নির্দিষ্ট দিনে আমরা দুজন অভিজ্ঞ মাঝি নিয়ে দেবীদ্বার ঘাট থেকে যাত্রা শুরু করলাম। জীবনের প্রথম নৌকা ভ্রমণ হওয়ায় মনে আনন্দ ও শঙ্কা উভয় ছিল। কেননা একদিকে বর্ষাকাল; আকাশের মতিগতি বােঝা দায়। আর অন্যদিকে জীবনে প্রথম নৌকা ভ্রমণের আনন্দ উত্তেজনায় শিহরিত হলাম। আমরা আনুষঙ্গিক জিনিস হিসেবে নিলাম ক্যামেরা, টেপরেকর্ডার, খাবার পানি আর ফ্লাক্স ভর্তি চা। এছাড়া কিছু পরিমাণে শুকনাে খাবারও সঙ্গে নিলাম। আমাদের নৌকাটি দু জন দক্ষ মাঝির বৈঠার টানে গােমতী। নদীর বুকে যখন ভাসল তখন মন অচেনা এক শিহরণে পুলকিত হলাে।
যাত্রাপথের বর্ণনা : নৌকা গােমতীর পানিতে কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর মাঝিরা নৌকার পাল তুলে দিল। নদীর বুকে চারপাশের উন্মুক্ততা, মৃদুমন্দ বাতাসের মাতামাতি, নদীর জলের কলকল-ছলছল ধ্বনি-তরঙ্গে মন-প্রাণ ভরে উঠল। ছন্দময় বৈঠার ছলছল ধ্বনির সঙ্গে মাঝিরা গান ধরল মনমাঝি তাের বৈঠা নে রে, আমি আর বাইতে পারলাম না। বৈঠা আর পানির শব্দে যে অপূর্ব সংগীত লহরি সৃষ্টি করেছে তার সাথে মাঝিদের গান যেন অভিনব আর একমাত্রা যােগ করল। নৌকা হেলেদুলে চলতে লাগল। এ সময় নদীর দু তীরের নানা দৃশ্য চোখে পড়ল। নদীর ধারে কোথাও নানা ধরনের গাছগাছালি তাদের শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে পানিকে যেন ছোঁয়ার চেষ্টা করছে। আর কোথাও বিশাল মাঠজুড়ে কাশবনের সফেদ-শুভ্রতায় ভরা। বিশেষত নদীর তীরজুড়েই চারদিকে খােলা মাঠ, মাঝে-মাঝে শস্যভরা সবুজের সমারােহ এক অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে। স্নিগ্ধ-কোমল সূর্যকিরণে নদীর জল ঝলমল করছে। আকাশের নীল বুকজুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদাকালাে মেঘের ভেলা। কখনও কখনও দু একটি মাছ লাফিয়ে উঠে প্রাণচাঞ্চল্যের পরিচয় দিচ্ছে। নদীতীরে সাদা বকের দল নিবিষ্ট চিত্তে দাঁড়িয়ে মৎস্য শিকারের উদ্দেশ্যে। নদীর তীরের গাছগাছালি ও বাঁশঝাড়গুলাে পাখিদের কলকাকলিতে মুখর। নদীর উভয় পাশের দৃশ্যাবলি আমাদেরকে অনাবিল আনন্দে উদ্বেলিত করে তুলছে। নদী তীরের অধিবাসী মেয়েরা নদী থেকে পানি সংগ্রহে এসেছে। শাড়ি পরিহিত এরাই আমাদের দেশের গ্রামের কুলবধূ। তাদের গ্রামীণ রূপের পসরায় কলসি কাখে ঘরে ফেরার দৃশ্য অসাধারণ। কোথাও ক্ষেতের মেঠো পথ ধরে গ্রাম্য লােকজন গল্প করতে করতে হাটের দিকে যাচ্ছে। ততক্ষণে বেলা দুপুর হয়ে গেছে। আমাদের ক্ষুধা পেয়েছে। সঙ্গে যে শুকননা খাবার ও পানি ছিল তা দিয়ে খানিকটা উদরপূর্তি করলাম। আমাদের খাবার থেকে কিছু খাবার মাঝিদেরও দিলাম। তারাও পরম তৃপ্তিসহকারে তা খেল। অতঃপর ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে, চা পান করতে করতে পুনরায় আমরা যাত্রা শুরু করলাম। এক বন্ধু টেপরেকর্ডারে আব্দুল আলিমের ভাটিয়ালি গান চাপালাে- 'আরে ও রঙিলা নায়ের মাঝি/ তুমি এ ঘাটে লাগায়েরে নাও/ নিগুম কথা কইয়া যাও শুনি।' মনমাতানাে ভাটিয়ালি গানের সুরে আমাদের যাত্রাপথ যেন সংক্ষিপ্ত হয়ে গেল।
নদীতে সূর্যাস্ত : বন্ধুর বােনের বিয়ের উৎসব শেষ করে যখন আমরা বাড়ির দিকে রওনা হই ততক্ষণে বিকেল হয়ে গেছে। অর্থাৎ আমাদের বাড়ি পৌছাতে পৌছাতে রাত হয়ে যাবে। আমরা বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করার অল্প সময়ের মধ্যেই সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ল। সূর্যের রক্তিমাভায় পশ্চিম আকাশ, রঞ্জিত। ধীরে ধীরে দিনমণি পশ্চিম দিগন্তে যেন নদীতেই ডুবে যাচ্ছে। আমরা সবাই নৌকার ওপর বসে সে অপূর্ব দৃশ্য দেখছি। সেদিন ছিল আবার পূর্ণিমার রাত। সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পর পূর্ব দিকে চাঁদ উদিত হলাে। সূর্যের বিদায় আর চাদের আগমনে আমাদের যেন আর আনন্দের সীমা রইল না। 
নদীতে রাতের দৃশ্য : নদীতে রাতের বেলা অপরূপ মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পূর্বাকাশে উদিত হওয়া চাঁদের স্নিগ্ধ আলােয় নদীর জল রুপালি হয়ে উঠল। চাঁদ যেন আমাদের নৌকা ও স্রোতের সাথে নেচে নেচে আমাদের সঙ্গেই চলেছে। আমরা নদীর দু পাড়ের বৃক্ষরাজির সৌন্দর্য অবলােকন করছি। গ্রামের বাড়িগুলাে আলাে-অন্ধকারে ঢেকে আছে। নদীতে জেলেদের নৌকার আলােগুলাে আশ্চর্যজনকভাবে আমাদের হৃদয়ে এক ভিন্ন অনুভূতি সৃষ্টি করছে। আর তার সাথে পানিতে মাছ ধরার শব্দ। চারদিকে নীরবতার মাঝে পানির শব্দটুকু যে কতটা উপভােগ্য বােধ হয়, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। রাতের অপূর্ব মায়াবী প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি অবলােকন করতে করতে কখন গন্তব্যস্থানে অর্থাৎ বাড়ির নিকট এসে পড়েছি, তা আমাদের খেয়ালেই ছিল না। মাঝির ডাকে আমাদের হুশ হলাে যে, আমরা আমাদের গন্তব্যস্থলে এসে পড়েছি। নৌকা থেকে সবাই নেমে পড়লাম এবং মাঝিদের ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে যে যার বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম।
উপসংহার : আমার জীবনের প্রথম নৌকা ভ্রমণের আনন্দ, অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার কথা কখনও বিস্মৃত হবার নয়। হয়তাে কোনাে ভ্রমণের অভিজ্ঞতাই জীবনের পাতা থেকে একেবারে মুছে যায় না। কিছু স্মৃতি, কিছু কথা, কিছু আনন্দ চেতনার সাথি হয়ে থাকে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌকা ভ্রমণ বিচিত্র; আর কিছু না হলেও এর যে অভিজ্ঞতা, তা হৃদয়ে অনাবিল আনন্দ জাগিয়ে রাখে বহু সময় ধরে।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment