SkyIsTheLimit
Bookmark

রচনা পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার

পরিবেশ দূষণের পরিণাম
ভূমিকা: পৃথিবী নামক গ্রহটিকে যে আলাে-বাতাস-পানি-গাছপালা ঘিরে রয়েছে তাই তার প্রকৃতি। এ প্রকৃতির সবচেয়ে সুবিধাভােগী হলাে মানুষ। বলা হয়ে থাকে, মানুষ পরিবেশের সৃষ্টি। মানুষ তার প্রতিভা, পরিশ্রম আর দক্ষতা দিয়ে আবিষ্কার করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন অনুষজ্গ। অধিগত করেছে জীবন-বিকাশের নানা উপকরণ। তাই দিয়ে সে তার নিজের প্রয়ােজন ও রচি অনুযায়ী তৈরি করেছে তার পরিবেশ। এ পরিবেশের মধ্যেই তার বিকাশ, তার বিনাশের ইঙ্গিত। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিজ্ঞানের বিজয়গৌরবে মােহান্ধ মানুষ পৃথিবীর পরিবেশকে বিষাক্ত করেছে। চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে ক্ষতিকর সব আবর্জনা। তার ফল হয়েছে বিষময়। পরিবেশ দষিত হয়েছে। আর দৃষিত পরিবেশ প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করছে। তাই গােটা জীবজগতের অস্তিত্বই আজ বিপন্ন।
পরিবেশ দূষণের কারণ: জনসংখ্যা বৃদ্ধি পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রাকৃতিক সম্পদ জেল-মাটি-বায়ুর ওপর পড়েছে। প্রচণ্ড চাহিদার চাপ। শুরু হয়েছে বনসম্পদ বিনষ্টের অমিত উল্লাস। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উদ্ভিদজগৎ ও প্রাণিজগৎ। অক্সিজেনের প্রধান উৎস গাছপালা। যে জায়গায় গাছপালা নেই, সে জায়গায় জনপ্রাণীও নেই । বর্তমানে প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য এসে পৌছেছে এক সংকটজনক অবস্থায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্রমবর্ধমান হারে শক্তি উৎপাদনের চাহিদা। শক্তি উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে নির্গত হয় মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ-দূষক নানা উপজাত দ্রব্য। এতে বায়ু, জল, খাদ্যদ্রব্য মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। এসব উপজাত দ্রব্যই নানাবিধ দুরারােগ্য ব্যাধির দ্রুত প্রসারণের কারণ।
পরিবেশ দূষণের শ্রেণি: আমাদের পরিবেশ দূষণকারী অপদ্রব্যগুলাে মোটামুটি দু ভাগে বিভক্ত। ১. প্রাকৃতিক ও ২. কৃত্রিম। প্রাকৃতিক দূষণের মধ্যে রয়েছে। সীসা, পারদ, সালফার ডাই-অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনােক্সাইড ইত্যাদি। এর মধ্যে কতগুলো আবার আমাদের মল-মূত্র ও শরীরের পচন থেকে উৎপন্ন। তার ওপর আছে কৃত্রিম-দূষকের সমস্যা। কৃত্রিম-দূষকের অন্তর্গত হলাে, নানা কীটনাশক, গুঁড়াে সাবান, ওষুধপত্র ও প্রসাধন সামগ্রী, এমনকী প্লাস্টিকও। এসব যৌগের কয়েকটি আমাদের পরিবেশে বহুদিন ধরে টিকে থাকে। রোদ, জল, বাতাস, জীবাণু এদের কোনাে ক্ষতিই করতে পারে না। এ ধরনের যৌগ নিয়েই পরিবেশ-বিজ্ঞানীদের দুশ্চিন্তা বেশি। কেননা কিছুদিন আগেও পৃথিবীর বুকে এ ধরনের যৌগের অস্তিত্ব ছিল না।
বায়ু দূষণ ও নানা প্রতিক্রিয়া: দূষণের প্রকৃতি ও পদ্ধতির মধ্যেও রয়েছে বিভিন্নতা। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের অন্যতম সম্ভার হলাে বায়ু। সেই বায়ু দূষণ আজ সারা বিশ্বজুড়ে। মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষেও এ এক গরতর সমস্যা। ঝল জাতীয় কার্বন কণা থেকে শুরু করে ভারী ধাতু, জটিল জৈব যৌগ নিউক্লীয় আবর্জনা, জীবাশ্ম জ্বালানি অর্থাৎ তেল, কয়লা ইত্যাদি পুড়িয়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে ছড়িয়ে দেওয়া ক্লোরােফুরােমিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, রাসায়নিক ধোঁয়া ইত্যাদি সবই হলাে বায়ু দূষণকারী দ্রব্য। বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ নিয়ত বাড়ছে। এর ফলে পৃথিবীতে তাপমাত্রা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। অকাল-বর্ষণ, খরা, ঝড়-ঝঞা, কুয়াশা এরই ফলশ্রুতি। এরকম আবহাওয়ায় চাষ-বাস হয় অনিশ্চিত। কুয়াশা আর তেল, কয়লা দহনের ফলে নির্গত গ্যাসের মিশ্রণে ধোঁয়াশার সৃষ্টি। এর ক্ষতিকারক ক্ষমতা মারাত্মক। মাথাধরা, শ্বাসকষ্ট, হাপানি, দীর্ঘস্থায়ী ব্রংকাইটিস, ফুসফুস-ক্যান্সার এ জাতীয় দূষণের ফল। বিভিন্ন যানবাহনের নির্গত ধোয়া সূর্যের আলাের সংস্পর্শে এসে তৈরি করে আলােক রাসায়নিক ধােয়া। অক্সাইড ও হাইড্রো কার্বনের বিক্রিয়ায় আরও কিছু বায়ু দূষকের সৃষ্টি হয়। ওজোন গ্যাস ও পারক্সি-অ্যাসিটালনাইট্রেট তাদের মধ্যে অন্যতম। এতে তরিতরকারি ও শস্যের ক্ষতির পরিমাণ মারাত্মক। এ ছাড়া আরও এক ধরনের বায়ুদৃষক আবহাওয়ায় ছড়িয়ে থাকে। ওগুলাে বাতাসে ভেসে বেড়ানাে জীবাণু। অ্যালার্জিজনিত রােগে ওইসব জীবাণুর ভূমিকা অনেক।
পানি দূষণ: পানি দূষণ আধুনিক সভ্যতার আর এক অভিশাপ । পৃথিবীর সমুদ্র, নদ-নদী, পুকুর, খাল-বিল ইত্যাদির পানি নানাভাবে দূষিত হচ্ছে। ভারী ধাতু, হ্যালােজেন নিষিক্ত হাইড্রোকার্বন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, পেট্রোলিয়াম, কৃত্রিম তেজস্ক্রিয় পদার্থ, সর্বোপরি সংলগ্ন শহরের নির্গমনালী বেয়ে আসা দূষিত তরল, আবর্জনা এগুলােই পানি দূষণের প্রধান উপকরণ। তা ছাড়া পারিপার্শ্বিক আবহাওয়ার পৃরিবর্তনেও সমুদ্রের দূষণ হচ্ছে। নদীর তীরে গড়ে উঠেছে সমৃদ্ধ ঘন বসতিপূর্ণ জনপদ, শহর। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আধুনিক চটকল, কাপড় কল, কয়লা ধােলাই কল, চিনি কল, কাগজের কল, ভেষজ তেল তৈরির কারখানা, চামড়া পাকা করার কারখানা ইত্যাদি। এসব কল-কারখানার আবর্জনা প্রতিনিয়ত নদ-নদীকে দৃষিত করছে। পুকুর, খাল-বিল দূষণের জন্যে নালা-নর্দমা, ঘর-বাড়ির আবর্জনা ইত্যাদি দায়ী। এর থেকেই দৃষিত হয় মাটি, দৃষিত হয় পানীয়জল। সমুদ্র, নদী, খাল-বিল; পুকুরের মাছেও নানারূপ দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে। বিস্তার লাভ করছে নানারকমের সংক্রামক রােগ। মাঝে মাঝে তা মহামারির আকার ধারণ করে। মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিয়ে যায় কত জীবন। এমনি করেই দিনের পর দিন জনস্বাস্থ্য বিনষ্ট হচ্ছে। 
শব্দ দূষণ: শব্দ দূষণ এ যুগের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শহরে শব্দ দূষণের মাত্রা সর্বাধিক। প্রতিনিয়তই এখানে মােটর গাড়ির হর্ন, কল-কারখানার বিকট আওয়াজ, বাজি-পটকার শব্দ, রেডিও-টেলিভিশনের শব্দ, লােকজনের চিৎকার-চেঁচামেচি, উৎসবের মত্ততা, মাইকে চড়া সুর, সব মিলে-মিশে অপস্বর সৃষ্টির এক মহাযজ্ঞ চলছে। শব্দ দূষণের পরিণাম ভয়াবহ। এর ফলে মানুষের শ্রবণ-ক্ষমতার বিলােপ ঘটে। মানসিক বিপর্যয় দেখা যায়। রক্তচাপ বেড়ে যায়। অনিদ্রা রােগের উদ্ভব হয়। হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি ও স্নায়বিক অস্থিরতাও শব্দ দূষণের পরিণাম। শব্দের ২০ থেকে ৪০ ডেসিবেল পর্যন্ত মাত্রা হলাে স্বাভাবিক। ঢাকায় এখন শব্দের পরিমাণ ৬০ থেকে ৬৫ ডেসিবেল, কোথাও কোথাও ৮০ ডেসিবেল. ‌। 
তেজস্ক্রিয় দূষণ: আয়নকারী বিকিরণ শক্তির এক ক্ষমতাশালী উৎস। সায়ানাইড বা অন্যান্য বিকারকের তুলনায় এর তাপশক্তি দশ কোটি গুণ তীব্র। পারমাণবিক যুদ্ধ, পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে তেজস্ক্রিয় দূষণের বিপদ সবচেয়ে বেশি নিহিত। ১৯৬৩-তে একটি মার্কিন নিউক্লীয় সাবমেরিন আটলান্টিক সাগরে হারিয়ে যায়। তা থেকে প্রচুর পরিমাণে তেজস্ক্রিয় পদার্থ ছড়িয়ে পড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে। নিউক্লীয় জ্বালানি উৎপাদনকেন্দ্রের আবর্জনা তার ক্ষতিকারক ক্ষমতা নিয়ে ৬০০ বছর টিকে থাকতে পারে। প্লুটোনিয়ামের অর্ধ আয়ু ২৪,৩৬০ বছর এবং তার ক্ষতি করার ক্ষমতা ওই অর্ধ আয়ুর কয়েক গুণ সময় পর্যন্ত বজায় থাকে। 
দূষণের প্রতিকার: দূষণের ভয়াবহ পরিণামের কথা ভেবে বিশ্বের সভ্যমানুষ আজ আতঙ্কিত। কী উপায়ে এ ভয়ংক্র সমস্যার মােকাবেলা সম্ভব তা নিয়ে ভাবনা, পরিকল্পনার শেষ নেই। বায়ু দূষণের প্রতিকারের জন্যে গ্রহণ করা হয়েছে কল-কারখানার দহন-প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে নির্গত দূষকের পরিমাণ কমানাের ব্যবস্থা। নির্দিষ্ট এলাকায় যাতে দূষণের প্রভাব ঘনীভূত না হয় তার জন্যে দূষকগুলােকে আরও বড় এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে, দহনে উৎপন্ন গ্যাসে অতিরিক্ত কোনাে পদার্থ মিশিয়ে দেওয়ার, যাতে নির্গত হওয়ার আগেই কোনাে কোনাে দূষক অপসারিত হতে পারে। তাছাড়া গ্রহণ করা হয়েছে বৃক্ষরােপণ পরিকল্পনা। দূষণ-প্রতিরােধী উদ্ভিদের সংখ্যা বাড়ানাে খুবই জরুরি। সমুদ্র দৃষণের প্রতিকারের জন্যে প্রয়ােজন বিভিন্ন উপদ্বীপ ও উপকূল অঞ্চলে সমুদ্র দূষণের পরিমাণ নিয়মিত পরিমাপ করা, প্রয়ােজন সেসব এলাকায় দৃষণ-বিরােধী বিধি-নিষেধ কার্যকর করা। দূষিত পানিকে পানযােগ্য করে তুলতে হলে উপযুক্ত পরিস্রাবণ দরকার। শব্দ দূষণের কুপ্রভাব কমানাের প্রধান উপায় হলাে, কানে তুলাে ব্যবহার কিংবা শব্দ-বিরােধী কক্ষের ব্যবহার। প্রযুক্তিবিদ্যার সাম্প্রতিক অগ্রগতিতে এমন কতকগুলাে পদ্ধতির উদ্ভাবন হয়েছে, যাতে পরমাণু চুল্লীর আবর্জনা-নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে। এর ফলে হয়তাে নিউক্লীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উপজাত দ্রব্যে কোনাে তেজস্ক্রিয়তা থাকবে না। 
উপসংহার: পরিবেশ দূষণ সমস্যা নিয়ে আজ সকল দেশই চিন্তিত। মানবসভ্যতার অস্তিত্বই আজ সংকটের মুখােমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। তাই ১৯৭২ সালে মানুষের পরিবেশ নিয়ে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের অধিবেশন হয় স্টকহােম-এ। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিওডি জেনিরােতে অনুষ্ঠিত হয় বারাে দিনব্যাপী ধরিত্রী সম্মেলন। আমাদের দেশেও প্রতিবছর ৫ই জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসরূপে পালিত হচ্ছে। ২০০১ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভাতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলন। ২০০৯ সালের কোপেনহেগেন জলবায়ু সম্মেলন ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর ২০১৪ সালে পেরুর লিমায় বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। আজ পরিবেশ দূষণ মানবসভ্যতার এক ভয়ংকর বিপদ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে একটি নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তােলার লক্ষ্যে যে কোনাে মূল্যে পরিবেশ দূষণ রােধ করার প্রয়ােজন অনস্বীকার্য। সুকান্ত ভট্টাচার্যের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই- 
'এসেছে নতুন শিশু তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান 
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ পীঠে 
চলে যেতে হবে আমাদের। 
চলে যাব তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে 
প্রাণ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবাে জঞ্জাল 
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযােগ্য করে যাবাে আমি 
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।'

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment