SkyIsTheLimit
Bookmark

রচনা দারিদ্র একটি অভিশাপ

দারিদ্র বিমােচন 
বা দারিদ্র্য সমস্যা ও বাংলাদেশ
বা বাংলাদেশের দারিদ্র্য সমস্যা ও প্রতিকার
ভূমিকা : দারিদ্র মানব জীবনের একটি ভয়াবহ অভিশাপ । এটি মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে। দারিদ্রের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে জীবন হয় লণ্ডভণ্ড, মানুষ হয়ে উঠে অপরাধপ্রবণ তথা বিপথগামী। এটি ব্যক্তিজীবনে হতাশা, ক্ষোভ বিশৃঙ্খলা ও বিদ্রোহ বয়ে আনে এবং সমাজ ও জাতীয় জীবনে উন্নতির পথ রুদ্ধ করে। বাংলাদেশে দারিদ্র্ শুধু একটি সমস্যাই নয়, আরাে বহু সমস্যার কারণও বটে। দারিদ্র্য এ দেশের উন্নতির পথে বড় বাধাস্বরূপ। দারিদ্র্য আমাদের মৌলিক চাহিদার উপর কষাঘাত হানে। তাই মানুষ চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক জীবনে দারিদ্রের প্রভাব : বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি অনুন্নত ও দারিদ্র্য পীড়িত দেশ। এদেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক জীবনের এমন কোনাে দিক নেই যা দারিদ্র্যের প্রভাবমুক্ত। কি শিক্ষা, কি সাস্থ্য, কি আবাসন, কি চিকিৎসা, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই পিছিয়ে আছি আমরা। দেশের শতকরা ৪৬ ভাগ লােকই দারিদ্র্ সীমার নীচে श्रा বসবাস করে। দু বেলা পেট ভরে অন্ন সংস্থানের নিশ্চয়তা নেই তাদের, পরিধেয় বস্ত্র নেই, এমনকি রােদ-বৃষ্টি-ঝড়ে মাথা গোঁজার ঠাইও নেই। সুতরাং আমাদের কৃষির অনগ্রসরতায়, নিরক্ষরতা বৃদ্ধিতে, শিল্পের অনগ্রসরতায়, বেকারত্ব বৃদ্ধিতে, পুষ্টিহীনতা ও স্বাস্থ্যহীনতা সৃষ্টিতে, চুরি-ডাকাতি, ঘুষ-দুর্নীতি প্রভৃতির নিয়ামক হিসেবে দারিদ্রের প্রভাব অত্যন্ত ভয়াবহ।
বাংলাদেশের দারিদ্র্যে চিত্র : বাংলাদেশ দারিদ্র্যচক্র বিদ্যমান। এদেশে দারিদ্র্যেচিত্র সহসা বদলাবে এমন কোনাে আশাও করা যাচ্ছে না। এদেশে শতকরা ৪৭ জন মানুষ গ্রামে বাস করে দারিদ্র্সীমার নিচে। মাথাপিছু আয় মাত্র ৪৪০ ডলার। কর্মক্ষম শতকরা ৫৩ ভাগ মানুষ পূর্ণ বা প্রচ্ছন্ন বেকার। নূন্যতম শিল্পায়ন, সঞ্চয় ও মূলধন গঠনে পশ্চাৎপদতা, ভঙ্গুর অবকাঠামাে, দুর্নীতর সর্বগ্রাসী প্রসার, অপুষ্টি, শিশুমৃত্যু প্রভৃতি নেতিবাচক সূচক এদেশের সার্বিক জীবন চিত্রকে অসহনীয় দারিদ্রে নিক্ষিপ্ত করেছে।
বাংলাদেশের দারিদ্র্যের কারণ : দারিদ্র্যে একটি আপেক্ষিক বিষয়। এর জন্য একক কোনাে কারণ দায়ী নয়। জন্য বহু কারণ প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে দায়ী। দারিদ্র্যের কয়েকটি মূল কারণ নিম্নে আলােচনা করা হলাে : 
ঔপনেবেশিক শাসন : বাংলাদেশে প্রায় দুশ বছর বৃটিশ শাসন এবং ২৫ বছর পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনাধীনে ছিল। এ দীর্ঘ সময় ধরে বিদেশী শশাষণের ফলে এদেশের জনগণ সব সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। তদুপরি আমাদের শীল্প অর্থনীতি যতটুকু ছিল তাও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। যার ফলে দারিদ্র্ এদেশে প্রকট আকার ধারণ করে। 
প্রাকৃতিক দুর্যোগ : প্রাকৃতিক দুর্যোগ এদেশের মানুষের নিত্যসঙ্গী। প্রতিবছর বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি নদী ভাঙন ও ঘূর্ণিঝড়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদ ও সম্পত্তি ধ্বংস হয়ে যায়। এতে হাজার হাজার লােক দরিদ্র ও নিঃস্ব হয়ে পড়ে। 
নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতা : নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতা বাংলাদেশে দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ। বর্তমানে বাংলাদেশে শতকরা ৩৮ ভাগ লােক নিরক্ষর। এ বৃহৎ নিরক্ষর জনগােষ্ঠী সহজে দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে না। তাই দারিদ্র্যে তাদের ঘাড়ে চেপে বসেছে। 
জনসংখ্যাধিক্য : অধিক জনসংখ্যা বাংলাদেশে দারিদ্র্যের অন্যতম প্রধান কারণ। এদেশে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে, সে হারে বাড়ছে না উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও অন্যান্য সুযােগ-সুবিধা। ফলে দেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামাে ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও অন্যান্য সুযােগ সুবিধা। ফলে দেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামাে ক্রমান্বয়ে দুর্বল ও হয়ে পড়ছে এবং উৎপাদন ও মাথাপিছু আয় ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। 
শিল্পে অনগ্রসরতা : বর্তমান বিশ্বের সকল উন্নত দেশই শিল্পোন্নত কিন্তু বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ নয় বলে শিল্পোন্নয়নে পুঁজি বিনিয়ােগ করতে পারছে না। ফলে এ দেশে শিল্পে অনগ্রসর রয়েছে। আর শিল্পোন্নয়নে অনগ্রসরতার জন্য কে দারিদ্র আমাদের নিত্যদিনের সাথী হয়ে আছে।
দারিদ্র্য বিমােচনে সার্কভুক্ত দেশগুলাের পারস্পরিক সহযােগিত : উন্নয়নশীল কোনাে দেশের পক্ষেই একক প্রচেষ্টায় দারিদ্র্য বিমােচন সম্ভব নয়। তাই এ কঠিনতম সমস্যা সমাধানে পারস্পরিক সহযােগিতার উদ্দেশ্যে দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের ক্রমন্বয়ে ১৯৮৩ সালের জানুয়ারি মাসে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বােতে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠন করা হয়। এ সংস্থার নামকরণ করা হয় সাউথ এশিয়ান এসােসিয়েশন ফর রিজিওনাল কো-অপারেশন সংক্ষেপে সার্ক। সার্কভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ। জন্মলগ্ন থেকেই এ সংস্থা কৃষি, গ্রামােন্নয়ন, যােগাযােগ, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা সমস্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযােগিতা বৃদ্ধির হাত সম্প্রসারিত করে আসছে। হলো 
দারিদ্র্ বিমােচন কর্মসূচী : সম্পূর্ণবূপে দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়া অসম্ভব ব্যাপার। তবু সম্মিলিত প্রচেষ্টার দ্বারা এ সমস্যার মােকাবেলা করা অনেকাংশে সম্ভব ১৯৯৪সালে অনুষ্ঠিত সার্ক পরিকল্পনামন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীদের এক বৈঠকে সার্কভূক্ত দেশগুলো থেকে দারিদ্র বিমােচনের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। এ কর্মসূচীগুলাে নিম্নরূপ: 
(১) অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে গড়ে তােলার জন্য শিল্পায়নের সুযােগ সম্প্রসারিত করা। 
(২) কৃষিকাজের বাইরেও প্রামীণ দরিদ্র জনগােষ্ঠী যাতে মৎস্য চাষ, পােলট্রি খামার স্থাপন, কুটির শিল্প স্থাপন ইত্যাদির মাধ্যমে আয়ের উৎস খুঁজে পায় সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। 
(৩) উন্নয়নমূলক খাতে সম্পদের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বরাদ্দ বন্ধ করা। 
(৪) দেশের দক্ষ-অদক্ষ জনশক্তি এবং বেকার জনগােষ্ঠীর জন্য দ্রুত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। 
(৫) বিদেশি বিনিয়ােগকারীদের জন্য বিনিয়ােগের যথাযথ সুযােগ সৃষ্টি করা এবং তারা যাতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার শিকার হয় সেদিকে লক্ষ রাখা। 
(৬) বিশাল জনগােষ্ঠীকে দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত করার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। 
বাংলাদেশের দারিদ্র্যে বিমােচনে সাম্প্রতিক চিত্র : ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তার বিশাল জনসংখ্যার অন্নবস্ত্রের সংস্থান করতে ব্যতিব্যস্ত। তা সত্ত্বেও সাম্প্রতিককালে দারিদ্র্য বিমােচনে কিছু ইতিবাচক লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বর্তমানে দেশে দারিদ্র্য বিমােচন কর্মসূচি সরকারি ও বেসরকারি দ্বিমুখী উদ্যোগে পরিচালিত হচ্ছে। সরকার আশ্রয়ন, ছাগল পালন, কৃষির বহুমুখীকরণ, খাসজমি বন্টন প্রভৃতি কর্মসূচি গ্রহণ করে সরকার সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি গটাতে আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছে। তাছাড়া গণশিক্ষা, কারিগরি প্রশিক্ষণ, জামানতবিহীন কৃষিঋণ, গবাদি পশুপালন, পােলট্রি ফার্মিং, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি প্রভৃতি জনগণের সার্বিক অবস্থার উন্নতি কল্পে ইতিবাচক অবদান রাখছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও)-গুলাে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত বিশেষত গ্রামীণ নারী সমাজের কর্মসুযােগ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ফলে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ইতিবাচক গতি সঞ্চার হয়েছে। 
উপসংহার : দারিদ্র্য মানবজীবনের এক চরম অভিশাপ । এটি বাংলাদেশের প্রধান জাতীয় সমস্যা। সমাজ থেকে দারিদ্র্য একেবারে নির্মূল করা সম্ভব না হলেও বর্তমানে তা বিমােচনের লক্ষ্যে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলাে বাস্তবায়িত হলে অনেকাংশে দারিদ্র্য লাঘব হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, কৃষি ও শিল্পোয়ন এবং রাজনৈতিক স্থিতীশীলতা দারিদ্র্য বিমােচনে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। সর্বোপরি বাংলাদেশ থেকে দারিদ্র্যে দূর করতে হলে অবশ্যই সার্ক কর্তৃক ঘােষিত পদক্ষেপগুলাে কার্যকর করতে হবে।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment