SkyIsTheLimit
Bookmark

রচনা আমার প্রিয় শিক্ষক

ভূমিকা:
সবারই স্মৃতিতে কেউ না কেউ বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। এ প্রভাব মানুষের জীবনচলার পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আমার জীবনে প্রভাব বিস্তারকারী মানুষ হলেন, আমার শিক্ষক মাে. হামিদুর রহমান। আমার সে প্রিয় শিক্ষকের নীতি-নির্দেশনা, চিন্তা-চেতনা-আদর্শ আমার জীবনচলার পথে পাথেয় হিসেবে বিবেচিত। আমি আমার প্রিয় শিক্ষকের জীবনবােধ, দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা প্রভৃতি অনুসরণ করতে চেষ্টা করি। এ মহান শিক্ষকের অবদান আমার জীবনের গঠন প্রক্রিয়ায় সবসময় ক্রিয়াশীল থাকবে। বাবা-মায়ের পরে আজীবন আমি তাকেই আপনজন বলে গণ্য করি।
প্রথম পরিচয়: আমার প্রিয় শিক্ষকের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের পর্বটা ছিল খুবই আকস্মিক। আমি তখন প্রাইমারি শিক্ষা শেষে হাই স্কুলে সবে ভর্তি হয়েছি। হাই স্কুলে যেদিন প্রথম ক্লাস করতে যাই সেদিন খুব ভয় ভয় করছিল। ভাবনা হচ্ছিল এলােমেলাে। না জানি কী হয়, না জানি স্যারেরা কেমন আচরণ করেন ছাত্রদের সঙ্গে। প্রাইমারি স্কুলের পরিসর আর হাই স্কুলের পরিসরের মাঝে যে বিস্তর ব্যবধান ছিল তা বুঝেছিলাম বলে স্কুলের প্রথম দিন এক কোণায় জড়ােসড়াে হয়ে বসেছিলাম । আমার প্রিয় শিক্ষকের ক্লাস ছিল দ্বিতীয় ঘণ্টায়। তিনি বাংলা পড়াতেন। বিদ্যালয়ের প্রথম দিনে আমি পানি পানের জন্য স্কুলের অফিস রুমে যাই। অফিস রুমের পাশের রুমেই যে স্যারেরা বসতেন তা আমি জানতাম না। স্যারদের রুমের দরজায় ঝােলানাে পর্দাটা একটু ফাক করে পরিস্থিতি বুঝতে চেষ্টা করলাম, কার কাছে পানি চাওয়া যায়। দপ্তরিকেও চিনতাম না বলে খুব অসুবিধায় পড়ে গেলাম। যেই স্যারদের রুমের পর্দা দ্বিতীয় বার ফাঁক করেছি অমনি একজন সৌম্য চেহারার লােক আমাকে কী চাই' জিজ্ঞেস করলেন। লােকটি যে স্যার ছিলেন তা তখন বুঝিনি। কারণ, নতুন ছাত্র হিসেবে কারও সঙ্গেই পরিচয় ছিল না। যাক সে কথা, আমি পানি পানের কথা বললে তিনি নিজে উঠে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে আমাকে দিলেন। আমিও তৃষ্ণার্ত কাকের মতাে চুকচুক করে পানি পান পর্ব সেরে ক্লাসে চলে আসি। দ্বিতীয় ঘণ্টার ক্লাস করার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় দেখি যিনি আমাকে তখন পানি দিয়েছিলেন তিনিই এসেছেন ক্লাস নিতে। আমার অবস্থা ত্রাহি ত্রাহি। স্যারকে পানি খাওয়ার কথা বলেছি, তিনি নিজের হাতে আমাকে পানি খাইয়েছেন, এগুলাে ভাবতেই আমার চিন্তা-চেতনা মুহূর্তেই তালগােল পাকিয়ে গেল। টেবিলের ওপর রােলকলের খাতাটা রেখে স্যার ক্লাসের চারদিকে তাকালেন। উদ্দেশ্য সবাইকে একনজর দেখা। আমার ওপর চোখ পড়তেই তিনি হেসে উঠলেন। আমাকে উনার কাছে যাওয়ার জন্যে বললেন। আমি ভয়ে ভয়ে তার কাছে গেলে তিনি নাম জিজ্ঞেস করলেন। পরে কোন রুমে, কার কাছে গেলে পানি পাওয়া যাবে সে কথা বললেন। স্যারের সেই স্নেহসিত্ত কথাগুলাে এবনও আমার কানে বাজে।
কী পেলাম: আমার প্রিয় শিক্ষক আমাদের বাংলা পড়াতেন। তার ক্লাসে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করত। কারণ তাঁর অসাধারণ বাচনভঙ্তি, বােঝানাের ক্ষমতা এবং সদা হাস্যোাজ্জ্বল চেহারা মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখত ছাত্রদের। স্যারের কাছ থেকে অনেক কিছু পেয়েছি। জীবন সম্পর্কে ইতিবােচক ধ্যানধারণার নির্দেশনা পেয়েছি। মানবিক গুণাবলি চর্চা করার অনুপ্রেরণা লাভ করেছি তার কাছ থেকেই। শিক্ষা যে শুধু একমুখী একটি বিষয় নয়, বরং শিক্ষা মানুষের জীবনে বহুমাত্রিক বোধের উন্মেষ ও বিকাশ ঘটায় তা স্যারের কাছ থেকেই শিখেছি। তাঁর পিতৃসম আদর, স্নেহ, শাসন প্রভৃতি আমাকে আদর্শ মানুষরূপে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে
বাস্তব জীবনে স্যারের পরামর্শ: স্যারের কাছ থেকে আমি যা পেয়েছি তার ব্যাপকতা অপরিসীম। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে স্যারের জীবনযাপন, চিন্তা- চেতনা, আদর্শ আমাকে পথ দেখায়। স্যারের কাছ থেকে শিক্ষার মৌলিক ভিত্তি অর্জন করে আমি ব্যবহারিক জীবনে সে ভিত্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার উপায় খুঁজে পেয়েছি। জীবনে চাওয়া-পাওয়ার শেষ নেই, অধৈর্য হলে চলবে না, অর্থশক্তির চেয়ে জ্ঞানশক্তি বড়- এসব বাক্য স্যার প্রায়ই বলতেন। স্যারের বলা এসব বাক্য আমার চিন্তা-চেতনাকে সবসময় আচ্ছন্ন করে রাখে। মানবতার জয়গান ছিল স্যারের দর্শনের অন্যতম বিষয়। আমি আমার জীবনে মানবতাকে সবার ওপরে স্থান দিয়েছি। আর্তপীড়িত মানুষ দেখলেই স্যারের কথা মনে পড়ে যায়। আমি তখনি ছুটে যাই তাদের সেবা করার জন্য। সত্য ও ন্যায়ের পথে চলার উপদেশ দিয়ে স্যার আমাকে ব্যবহারিক জীবনে এসব পালনের যে তাগিদ দিয়েছিলেন বার বার আমি সে তাগিদ অনুভব করি‌।
আদর্শ ব্যক্তিত্ব: আমার প্রিয় শিক্ষক আমার কাছে শুধু শিক্ষকই নন তিনি হলেন আমার আদর্শ ব্যক্তিত্ব। আমি তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত এবং উজ্জীবিত। আমি আমার প্রিয় শিক্ষকের আদেশকে বেছে নিয়েছি জীবন গড়ার আদর্শ হিসেবে। মানবতাবাদী, মুক্তচিন্তার অধিকারী, সংস্কৃতিসেবী আমার এ প্রিয় শিক্ষকের আদর্শকে আমার মাথার আদর্শিক মুকুট হিসেবে তুলে নিয়েছি। 
বর্তমানের অনুভূতিতে হারানাে অতীত: সময় বদলে যায় চিরন্তন নিয়মেই। কিন্তু সময়ের পিঠে রচিত ঘটনা স্থায়ী হয়ে থেকে যায় মানুষের মনে। স্যারের কথা মনে পড়লে আমার মনটা হু হু করে ওঠে। শুনেছি তিনি এখন অবসর গ্রহণ করে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছেন, অথচ এ স্যারকে স্কুলে দেখেছি প্রাণবন্ত মানুষ হিসেবে। কর্মচঞল আর উদ্দাম আবেগধারী স্যারের প্রতিচ্ছবি এখনও আমার মানসপটে ভেসে ওঠে। যেকোনা বিষয়েই স্যার ছিলেন একনিষ্ঠ। ছাত্রদের জন্যে তাঁর আবেগ, উচ্ছ্বাস, দরদ সত্যিই দৃষ্টান্তমূলক। যেদিন স্কুল ছেড়ে চলে আসছিলাম, সেদিন স্যার আমাকে ধরে শিশুর মতাে অঝােরে কেঁদেছিলেন। দোয়া করেছিলেন বলেছিলেন, 'জীবনের ও জীবিকার প্রয়ােজনে যে যাই হও না কেন, সবার আগে যেন মানুষ হয়াে। জানি না কতটা মানুষ হতে পেরেছি। তবে যতটুকু পেরেছি তা আমার প্রিয় শিক্ষকের জন্যেই সম্ভব হয়েছে-একথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি‌। 
উপসংহার: আমার প্রিয় শিক্ষক আমার কাছ থেকে বাস্তবতার কারণে দূরে থাকলেও তিনি আমার অন্তরজুড়ে রয়েছেন, রয়েছেন আমার ভাবনাজুড়ে। আমি আমার প্রিয় শিক্ষকের জন্যে গৌরব বোধ করি। আমি মনে করি, আমার প্রিয় শিক্ষককে পেয়ে সত্যি আমি ভাগ্যবান।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment