বা বেকার সমস্যা ও কারিগরি শিক্ষা
বা কারিগরি শিক্ষা
ভূমিকা: শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা মানুষকে জ্ঞানের আলাে দান করে, সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করে, মানুষে মানুষে সম্প্রীতি বাড়ায় এবং সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে করে সমৃদ্ধ। তাই শিক্ষাকে হওয়া চাই জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষাই কর্মমুখী শিক্ষা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সমালােচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- 'আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষার সঙ্গে জীবনের কোনা সংযােগ নেই।' বাস্তবিকই প্রচলিত শিক্ষা আমাদের জীবনকে ভবিষ্যতের জন্যে প্রস্তুত করে না। আজ পুথিবী দ্রুতবেগে এগিয়ে যাচ্ছে কর্মময় শিক্ষার দিকে। আমাদের জীবনের জন্যেও তাই সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে কর্মমুখী শিক্ষা অতীব প্রয়ােজনীয়।
কর্মমুখী শিক্ষা কী: যে শিক্ষাব্যবস্থায় মানুষ কোনাে একটা বিষয়ে হাতে-কলমে শিক্ষালাভ করে জীবিকার্জনের যােগ্যতা অর্জন করে, তা-ই কর্মমুখী শিক্ষা। অর্থাৎ বৃত্তিমূলক বা কর্মমুখী শিক্ষার অর্থ হচ্ছে একজন ব্যক্তিকে বিশেষ বৃত্তি বা কর্মে প্রশিক্ষিত করে তােলা। শিক্ষাকে হতে হবে আত্মপ্রতিষ্ঠায় সহায়ক। অন্যথায় সে শিক্ষা হবে নিরর্থক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিনের মতে, 'Vocational education is important and essential for our development which must be evaluated sooner or later. ' বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দেশে বেকার সমস্যার সমাধান দিতে পারছে না। তাই দিন দিন শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এ সমস্যার মােকাবেলা করতে হলে কর্মমুখী শিক্ষা চালু করা অতীব প্রয়ােজন।
কর্মমুখী শিক্ষার প্রকারভেদ: কর্মমুখী শিক্ষা দ্বিবিধ। একটি হলাে— ডাক্তার, প্রকৌশলী এবং কৃষিবিদ; যারা বিভিন্ন কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে উচ্চ ডিগ্রি লাভ করেন। তারা ইচ্ছেমতাে স্বাধীন পেশায় নিয়াজিত হতে পারেন। চাকরির আশায় তাদেরকে বসে থাকতে হয় না। অন্যটি হলাে সাধারণ কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা। এ শিক্ষার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রির প্রয়ােজন হয় না। সাধারণত প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক শিক্ষাই যথেষ্ট। এ শিক্ষায় শিক্ষিত হলে কাউকেই খাওয়া-পরার ব্যাপারে ভাবতে হয় না। এ জাতীয় শিক্ষার মধ্যে-ধাত্রী বিদ্যা, সেলাই কাজ, কাঠমিস্ত্রীর কাজ, দর্জির কাজ, ছাপাখানার কাজ, বই বাঁধাই, বিদ্যুতের কাজ, টেলিভিশন-রেডিও-মােটরযান মেরামতের কাজ, ওয়েন্ডিং-এর কাজ, কারখানায় শ্রমিকের কাজ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা: আধুনিক দুনিয়ায় বেঁচে থাকার জন্যে নানা কলাকৌপল আরিষ্ত হয়েছে। অথচ ব্যবসা-বাণিজ্যে, সভ্যতা-সংস্ জীবন-যাত্রায় আমরা ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছি। কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবদ্থা এখনও পরাধীন যুগের। এখনও ব্রিটিশদের কেরানি বানাবার। শিচ্চাব্যবস্থা আমাদের দেশে প্রচলিত। কর্মমুখী শিক্ষার সম্প্রসারণ এখনএ হয়ানি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের কথা ওঠে ঠিকই, ব গঠিত হয়, এর রিপাের্টও প্রকাশিত হয় কিন্তু বাস্তবে তা প্রয়ােগ করা হয় না। অবশ্য শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের লক্ষ্যে দেশে মাধ্যমিক স্তরে 'এসবিএ চালু হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশের ৪৮ জন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দানের মাধ্যমে এর যাত্রা শর। এর লক্ষ্য বাস্তবতার আলােকে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাদান। এ ধরনের পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্যে শিক্ষাব্রতীদের অধিক সচেতন হতে হবে। কিন্তু আমাদের মন-মানসিকতা সেই পুরােনাে আমলের। একগুয়ে অহংকারের আভিজাত্য ত্যাগ করতে পারছে না। ফলে অনেক শিক্ষিত যুবক অভিশপ্ত বেকার জীবনযাপন করছে। গতানুগাতিক গ্রন্থগত শিক্ষাব্যবস্থা ডিগ্রিধারী শিক্ষিত ব্যক্তি তৈরি করছে বটে, কিন্তু তা কর্মভিত্তিক না হওয়াতে ফলপ্রস হয়ে উঠছে না। ফলে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি থমকে আছে। এ অবস্থার পরিবর্তন আনতে হলে কর্মমুখী শিক্ষা প্রবর্তন অত্যাবশ্যক।
কর্মমুখী শিক্ষার প্রয়ােজনীয়তা ও গুরুত্ব: কর্মমুখী শিক্ষার প্রয়ােজনীয়তা বহুবিধ। এ শিক্ষা গ্রহণের পর একজন শিক্ষার্থীকে চাকরির জন্যে দ্বারে দ্বারে ঘুরে জীবনক্ষয় করতে হয় না। এ শিক্ষা বেকারত্বের অভিশাপ থেকে দেশকে মুক্ত করে, দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও দারিদ্র্য মােচনে সাক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এ শিক্ষা রুজি-রােজগারের পথ খুলে দেয় এবং কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দেয়। কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তিকে আমরা বিদেশে পাঠিয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি। তাই কর্মমুখী শিক্ষা আরও ব্যাপক ও বাস্তবমুখী হওয়া প্রয়ােজন। বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ একটি দরিদ্র দেশ। দেশের উন্নয়নের স্বার্থে এ বিশাল জনগােষ্ঠীকে কর্মমুখী শিক্ষা দিয়ে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে। বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে শিল্প, বিজ্ঞান, কারিগরি উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধনের উপযােগী করে তুলতে পারলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এবং বেকার সমস্যার সমাধান হবে। কর্মমুখী শিক্ষার ওপর যত বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে, ভবিষ্যতে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা তত সুদৃঢ় হবে। তাই আমাদের উচিত এ শিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারােপ করা।
প্রচলিত কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা: আমাদের দেশে বর্তমানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষা প্রচলিত। তার সঙ্গে কারিগরি, প্রকৌশলী, ডাক্তারি, ভকেশনাল ইত্যাদি কর্মমুখী পদ্ধতি প্রচলিত আছে। তবে তা প্রয়ােজনের তুলনায় অতি নগণ্য।
কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার: দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নয়নের জন্যে কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার ঘটানাে প্রয়ােজন। এ উদ্দেশ্যে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে অধিকসংখ্যক কর্মমুখী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তােলা প্রয়ােজন। বিশেষ করে কৃষিকার্যে সহায়ক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের ওপর অধিক জোর দিতে হবে। স্বল্পমেয়াদি কোর্সে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে আমাদের তরুণ বেকারদের সুদক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। বিভিন্ন কুটির শিল্প, বয়ন শিল্প, ডেইরি শিল্পের ওপর কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়ােজন। পাটকল, চিনিকল, ইস্পাত শিল্প, জাহাজ শিল্প ইত্যাদিতে দক্ষ কারিগর হিসেবে কাজ করতে পারে এমন সহায়ক কর্মমুখী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের ওপরও জোর দিতে হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যুগােপযােগী নতুন নতুন বিষয়ে কর্মমুখী শিক্ষা প্রবর্তন করতে হবে।
উপসংহার: বর্তমান যুগে কর্মমুখী শিক্ষার কোনাে বিকল্প নেই। একমাত্র কর্মমুখী শিক্ষাই দেশ ও জাতির সমৃদ্ধি বয়ে আনতে পারে। সাধারণ শিক্ষার দ্বারা মানসিক বিকাশ ঘটলেও কর্ম ও জীবিকার নিশ্চয়তা থাকে না। কর্মমুখী শিক্ষা সেই নিশ্চয়তা বিধান করে জীবনকে হতাশামুক্ত করে।
2 comments
Loved it
Porikkhay kaje lagbe
Thanks guys
Those who wrote it
Appreciate it
Keep it up
Best of luck