বা শিক্ষার উন্নয়নে ছাত্র-শিক্ষক
বা শিক্ষক বনাম অভিভাবক
ভূমিকা : ছাত্রের মনের সুপ্ত প্রতিভা জাগানাে, জ্ঞানের আলােয় তাদের অন্তর আলােকিত করা, তাদেরকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তােলার মহান দায়িত্ব শিক্ষকের। তাই শিক্ষকতা নেহাত চাকুরি নয় একটি মহান পেশা। ছাত্রদের শিক্ষার যথাযথ মান, এবং মানুষ হিসেবে গড়ে উঠা বহুলাংশে শিক্ষকের ভূমিকার ওপর নির্ভরশীল। সেদিক থেকে শিক্ষকের অবস্থান শিক্ষাব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে। অন্যদিকে শিক্ষকের মহৎ সাহচর্য, নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে ছাত্র প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠার সাধনায় নিজেকে ব্যাপৃত করে। নিজের জীবন বিকাশ, সদগুণাবলি অর্জন এবং ব্যক্তিত্বের জাগরণ শিক্ষকের সাথে যথাযথ যােগাযােগ ও সম্পর্কের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। বাবা-মায়ের পর শিক্ষকই যে ছাত্রের কাছে দ্বিতীয় পিতা বা মাতার মর্যাদায় আসীন হন তার মূলে রয়েছে ছাত্রের জীবনে শিক্ষকের বিশেষ ভূমিকা। তাই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ভূমিকাই বিশেষ 1. কার্যকর হলেও ছাত্র শিক্ষক উভয়ের ভূমিকা ও অবস্থানের উপর ঐ সম্পর্কের প্রকৃতি নির্ভর করে। সম্পর্কের বৈশিষ্ট্য : শিক্ষকের সঠিক ও যথাযথ দিকনির্দেশনা শিক্ষার্থীর জীবনকে সঠিক লক্ষ্যে পৌছাতে সাহায্য করে। শিক্ষকের সাহচর্য বা সংস্পর্শে না এলে শিক্ষার্থীর জীবন কখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে না। একজন মানুষের জীবনের পরিপূর্ণতা বলতে বােঝায় জীবনের বিকাশ, ব্যক্তিত্বের জাগরণ ও তার সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ। এ সুপ্ত প্রতিভার বিকাশে শিক্ষকের অগ্রণী ভূমিকার কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক যথেষ্ট পরিশ্রমী, ধৈর্যশীল ও অধ্যবসায়ী হয়ে শিক্ষার্থীর মনের খােরাক মেটাতে সচেষ্ট হন। শিক্ষক তার মেধা দিয়ে শিক্ষার্থীর মনে প্রচণ্ড কৌতূহল জাগিয়ে তােলেন।
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক : শিক্ষককে বলা হয়ে থাকে শিক্ষার্থীর দ্বিতীয় অভিভাবক। মাতাপিতা যেমন সন্তানসন্ততিকে মানুষ করে গড়ে তােলার দায়িত্ব পালন করেন শিক্ষকও তেমনি শিক্ষার্থীর জীবনকে পূর্ণাঙ্গ করার দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষকের অবদান আজকাল কোন একক শিক্ষকের ওপর বর্তায় না, তা সমষ্টিগতভাবে ভূমিকাকেই নির্দেশ করে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকের পক্ষে কোন প্রকার কার্পণ্যের পরিচয় দেওয়া চলে না। শিক্ষার্থী শিক্ষকের কাছ থেকে জানার জন্যে আকুল থাকে। আকুল উন্মুখ শিক্ষার্থীর তৃষ্ণা নিবারণ করা শিক্ষকের দায়িত্ব। মমতা ও শাসনের মেলবন্ধন ঘটিয়ে শিক্ষক সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীকে জ্ঞান দান করেন। এভাবে ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে এক মধুর ও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আদর্শ ও নিবেদিত প্রাণ শিক্ষকের জ্ঞান ও গুণে মুগ্ধ শিক্ষার্থী শিক্ষককে দেবতুল্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে। শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের যে ধারণা ছাত্রজীবনে গড়ে ওঠে তা সারাজীবন অম্লান থাকে। পরবর্তী জীবনে যত বড় বা মহৎ ব্যক্তিতে পরিণত হােক না কেন, শিক্ষকের প্রতি তার শ্রদ্ধার কোন ঘাটতি হয় না।
সম্পর্ক অর্থমূল্যে বিচার্য নয় : ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অর্থের ভূমিকা প্রধান নয়। এ কথা সত্য যে শিক্ষা গ্রহণের জন্যে শিক্ষার্থীকে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ফি দিতে হয়। অন্যদিকে শিক্ষক জীবিকা নির্বাহের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বেতন পেয়ে থাকেন। কিন্তু শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে অর্থের ভূমিকা গৌণ। অর্থ দিয়ে কখনও শিক্ষাদানের পরিমাণ নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। একজন যােগ্য ছাত্র গড়ে তােলায় শিক্ষক যে আনন্দ পান, ছাত্রের কাছ থেকে তিনি যে সম্মান ও শ্রদ্ধা পান অর্থ তাকে সে আনন্দ দিতে পারে না। অর্থমূল্যে সে আনন্দ কেনাও সম্ভব নয়। অন্য দিকে শিক্ষার্থী শিক্ষকের কাছ থেকে যে জ্ঞানলাভ করে, মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তােলার ক্ষেত্রে যে মূল্যবােধ অর্জন করে অর্থ দিয়ে তারও মূল্য পরিশােধ করা সম্ভব নয়।
সম্পর্কের প্রাচীন ঐতিহ্য : সেকালে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না বললেই চলে। শিক্ষার্থীকে গুরুগৃহে একটা নির্ধারিত সময় পর্যন্ত অবস্থান করে শিক্ষা গ্রহণ করতে হতাে। জাগতিক সমস্ত জ্ঞানের শিক্ষা গুরুগৃহ থেকেই শিক্ষার্থীরা গ্রহণ করতাে। শিক্ষাগুরুর সেবাযত্নের মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করে শিক্ষার্থী জীবনকে ধন্য মনে করত। গুরুর প্রতি শিষ্যের ভক্তি শ্রদ্ধাও ছিল অপরিসীম। প্রাচীন ভারতে, গ্রিস শিক্ষক শিক্ষার্থীর মধ্যে এভাবে এক অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক গড়ে উঠতাে। সে ঐতিহ্যের আদলে শিক্ষক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শিক্ষক হচ্ছেন ছাত্রের friend philosopher and guide. রবীন্দ্রনাথ ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্ককে বিচার করেছেন পরস্পরনির্ভর, সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক হিসেবে। সে সম্পর্ক কেবল পুঁথিগত বিদ্যা শেখান ও শেখার সম্পর্কের মধ্যে ছাত্র- আবদ্ধ নয়।
সম্পর্কের গুণগত পরিবর্তন : আধুনিককালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রচলন ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক কিছুটা ম্লান করেছে। এখন শিক্ষক শিক্ষার্থীর সম্পর্ক নিতান্তই আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শিক্ষকের কর্তব্যবােধকে করেছে। সংকুচিত এবং শিক্ষার্থী অবাধ কৌতূহলের গতিকে করেছে সীমিত ও শ্লথ। অর্থ লাভের তাড়নায় বহু শিক্ষক শিক্ষার্থীর গৃহে ছুটে যান এবং অর্থই বিদ্যা বিনিময়ের উপায় হিসেবে গণ্য হয়। দেখা যায়, অধিক বিত্তমান ব্যক্তির ছেলেমেয়েরা অর্থের বিনিময়ে নিয়ােজিত শিক্ষকের সানুগ্রহে ধন্য হয়ে প্রচলিত পরীক্ষায় ভালাে ফলাফল করতে সক্ষম হচ্ছে। যদিও সার্বিক বিচারে তাদের জ্ঞানচর্চার মান প্রশ্নসাপেক্ষ।
উপসংহার : ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বিরাজমান শিক্ষা ব্যবস্থা ও পরীক্ষা পদ্ধতির উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন। পরীক্ষার হলে দুর্নীতি নিরাময়, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস প্রতিরােধ, শিক্ষকের সততা ও কর্তব্যনিষ্ঠা, জ্ঞানার্জনে ছাত্রের একাগ্রতা তা ছাড়া ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের আদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়া কঠিন। মেধার অব্যাহত চর্চার মাধ্যমে জ্ঞানার্জন ও আলােকিত মানুষ গড়া যদি শিক্ষার উদ্দেশ্যে না হয়ে পণ্যমূল্যে শিক্ষা বিক্রির প্রধান হয়ে দাঁড়ায় তবে ছাত্র- শিক্ষকের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করা যাবে না। শিক্ষক ও ছাত্রসমাজ এবং শিক্ষানীতি প্রণেতারা, শিক্ষা কর্তৃপক্ষ যত তাড়াতাড়ি বিষয়টি উপলব্ধি করবেন ছাত্র-শিক্ষকের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের পুনরুজ্জীবন তত দ্রুত সম্ভব হবে।
Post a Comment