SkyIsTheLimit
Bookmark

রচনা আন্তর্জাতিক নারী দিবস

বিশ্ব নারী দিবস 
বা নারীর ক্ষমতায়ন
বা নারী দিবস ও বাংলাদেশ
ভূমিকা : পৃথিবীর মােট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী। কিন্তু এ নারীসমাজ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। পৃথিবীর প্রতিটি সমাজে নারীরা হচ্ছে নির্যাতিত, নিপীড়িত। তাই নারীরা বিশেষ করে ইউরোপের নারীরা তাদের প্রতি এ অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। তারা বিভিন্ন সভা, সেমিনার ও সম্মেলনের মাধ্যমে অন্যায় অন্যায্য আচরণের বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়। ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘ ৮ই মার্চকে 'আন্তর্জাতিক নারী দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি দান করে। নারীসমাজের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা তথা নারীসমাজের মধ্যে সংহতি ও সম্প্রীতি সুদৃঢ় করার অঙ্গীকার নিয়ে জাতিসংঘের সহযােগিতায় প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী এ দিবস পালিত হয়ে থাকে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট :
প্রথমত : ১৯৭২ সালে ব্রিটেনে ম্যারি ওয়েলস্টোন ক্রাফট নারী ও পুরুষকে এক মানদণ্ডে বিচারের দাবি জানান। কেবলমাত্র শিক্ষা নয়, রাজনৈতিক আইনবিধিতে সংশােধনী এনে নারীর অধঃস্তন অবস্থা বদলে ফেলার দাবি জানান। তবে তাঁর উক্তির যথাযথ মূল্যায়ণ হয় পরবর্তী শতক।
দ্বিতীয়ত : সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের বিপ্লবী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিকাশ, ইংরেজদের গৃহযুদ্ধ, ফরাসি বিপ্লব, শিল্প বিপ্লব প্রভৃতি কারণে পুরুষ সমাজ নতুন নতুন অধিকার ভােগ করে। এ সময়ই নারীরা মৌলিক অধিকার হিসেবে রাজনৈতিক ও আইনগত অধিকার, সন্তানের উপর আইনগত দাবি, সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা ও ভােট দেবার অধিকার চায়। 
তৃতীয়ত : ১৯৪৮ সালের জুলাই মাসে নিউইয়র্কের সেনেকা ফলস -এর কনভেনশনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভােটাধিকার তথা নারী মুক্তি আন্দোলনের সূত্রপাত মনে করা হয়। 
চতুর্থত : ১৯৫৭ সালের ৮ই মার্চ নিউইয়র্কের একটি সেলাই কারখানায় শােষণের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয় নারী শ্রমিকেরা। এর তিন বছর পর ১৮৬০ সালের ৮ই মার্চ নারী শ্রমিকদের এক মিছিলে গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে যে ইউনিয়ন গঠিত হয় তা নারী শ্রমিকের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে নেতৃত্ব দেয়। পরবর্তীতে ১৯১০ সালে কোপেন হেগেনে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে। জার্মান নারী নেত্রী ক্লারা সেভকিন প্রস্তাব করেন ই মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘােষণার। সম্মেলনে উপস্থিত বিভিন্ন দেশের নারী প্রতিনিধিরা এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানান। সে থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নারী প্রতিনিধিরা এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানান। সে থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে নারা দিবস ব্যাপক সাড়া জাগায় এবং পসারতা লাভ করে ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘের স্বীকৃতির মাধ্যমে। 
আন্তর্জাতিক নারী দিবস ও পশ্চিমা বিশ্ব : আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ঐতিহাসিক পটভূমি থেকে অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে উঠে যে, শুরুতে নারীসমাজের আন্দোলন ছিল মূলত নারী শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণের আন্দোলন। শিল্প বিপ্লবের ফলে ইউরােপ আমেরিকার কলকারখানায় নারী শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং পুরুষ শ্রমিকের সাথে তাদের বেতন ভাতার, বৈষম্যই সেদিনের সে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল। এ কারণেই বলা যায়, নারী শ্রমিকের শােষণের শুরুটা পাশ্চাত্যেই হয়। এদিক থেকে নারীসমাজের প্রতি শশাষণ নির্যাতনের যে ঐতিহ্য পাশ্চাত্যে রয়েছে তা প্রাচ্যে ততটা তীব্র ছিল না। 
আন্তর্জাতিক নারী দিবস ও বাংলাদেশ : নারী মুক্তি, নারীর ষ্বাধীনতা, সমঅধিকার, আত্মর্যাদার লড়াইকে সামনে এগিয়ে নেবার শপথ নিয়েই সারাবিশ্বের নারী পুরুষ এ দিবসটি পালন করে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশও ৮ই মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করছে। নারীর মুক্তি অর্থ সমাজের মুক্তি। সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার অন্যতম মাপকাঠি হচ্ছে নারীসমাজের উন্নতি। কিন্তু বিষয়টি মনের দিক থেকে মেনে নেবার অবস্থা আমাদের সমাজে এখনও তৈরি হয়নি। তাই ৮ই মার্চ পালনের প্রস্তুতি নারীসমাজকে নিতে হচ্ছে। প্রতিবছর সম্মিলিত নারীসমাজ এ দিবসটি ঘটা করে পালন করছে। এর পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে এবং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ এ দিবসটি পালন করে। কিন্তু বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে নারী দিবসের গুরুত্ব অত্যধিক। কেননা, ধর্মীয় বিধিনিষেধ, সামাজিক বাধা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রজনন প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর প্রতিবন্ধকতা জাতীয় অগ্রগতিকে বিলম্বিত করছে। 
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে জাতিসংঘের ভূমিকা : নারী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য জাতিসংঘ ৮ই মার্চকে বিশ্ব নারী দিবস হিসেবে ঘােষণা করে। নারীর মৌলিক অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি অর্জনের ব্যাপারেও জাতিসংঘ প্রচেষ্টা চালায়। এ লক্ষ্যে জাতিসংঘ ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৫ দশককে নারী দশক হিসেবে ঘােষণা করে। জাতিসংঘের সহযােগিতায় মেক্সিকো, কোপেন হেগেন, নাইরােবী এবং বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত হয় চারটি বিশ্ব নারী সম্মেলন। 
নারী দিবসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : নারীর কাজের স্বীকৃতি, পরিবেশ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় নারীর ভূমিকা, নারীর অধিকারকে মানবাধিকাররূপে ঘােষণা, উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে নারীর ক্ষমতায়ন, স্বীকৃতি, নারী পুরুষের সমতা নিশ্চিতকরণ, সারা বিশ্বে নারী নির্যাতন ও নিপীড়ন বন্ধ করা, শিক্ষা, প্রজনন প্রভৃতি ক্ষেত্রে নারীর প্রতিবন্ধকতা দূর করাসহ সকল ক্ষেত্রে নারীর সমান অংশগ্রহণ নারী দিবসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। 
বেইজিং চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন : ১৯৯৫ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিংশ শতাব্দীর সর্বশেষ আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন চীনের রাজধানী বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে ১শ' ৮৯টি দেশের প্রায় ৫ হাজার প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করে। বেইজিং নারী সম্মেলনের শ্লোগান ছিল নারীর চোখে বিশ্ব দেখুন”। বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসডেন্ট জেমস অলফেনশন তার সমাপ্তি ভাষণে মেয়েদের শিক্ষার জন্য বছরে ৯০ কোটি ডলার অনুদানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বলেন, এর ফলে বিশ্ব নেতৃত্বে নারীদের ভূমিকা শক্তিশালী হবে। 
সম্মেলনের বিতর্কিত বিষয় : বেইজিং নারী সম্মেলনের ১৫০ পৃষ্ঠার দলিলের যে বিষয়গুলাে নিয়ে সবচেয়ে তর্কবিতর্ক হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে যৌন স্বাধীনতা ও নারী নির্যাতন হ্রাস সংক্রান্ত বিষয়গুলাে। আলােচকদের মতে, এ বিষয়গুলাে নারী পাচার, মেয়ে শিশুদের পুষ্টিহীনতা ও যৌনতায় বাধ্য করার মত নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেন। 
উপসংহার : আজকের নারী আন্দোলন আন্তর্জাতিক রূপ পেয়েছে, যার পেছনে ১৮৫৭ সালের ৮ই মার্চের অবদানকে প্রধান হিসেবে ধরা হয়। শােষিত ও শ্রমজীবী নারী ন্যায্য মজুরি, অধিকার ও মর্যাদার দাবিতে কতটা সংঘবদ্ধ ও সাে্চার হতে পারে, দীর্ঘদিনের শােষণ কতটা বিক্ষুদ্ধ করতে পারে তার প্রমাণ নারী রেখেছিল, ৮ই মার্চে রক্ত ঝরিয়ে। যার ফলশ্রুতিতে ৮ই মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে গােটা বিশ্বে যথাযােগ্যভাবে পালন করা হয়ে থাকে।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment