বাংলাদেশে খাদ্য সমস্যার স্বরূপ: বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সম্পদ কৃষি জমি। কিন্তু কমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে আবাদি জমির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। ফলে খাদ্য উৎপাদন অনেক কম। খাদ্যের এ ঘাটতি মেটাতে প্রতিবছর প্রচর বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করতে হয়। তারপরও দেশে খাদ্যের অভাব থেকেই যায়। এর পেছনে কিছু প্রাকৃতিক এবং বেশ কিছু মানবসৃষ্ট কারণ বিদ্যমান।
খাদ্য সমস্যার কারণ: বাংলাদেশে খাদ্য সমস্যার কারণ বহুমাত্রিক। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় উন্নত দেশগুলাে খাদ্যশস্য আমদানি খাদ্য সমস্যা মেটানাের আর্থিক সংগতি রয়েছে তাদের। ফলে সেসব দেশে খাদ্য সংকট নেই। কিন্তু বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ তাে নয়ই, পর্যাপ্ত আমদানির মতাে আর্থিক সংগতিও বাংলাদেশের নেই। বাংলাদেশে এ খাদ্য সংকটের কারণগুলাে হলো:
১. লাগামহীন জনসংখ্যার তুলনায় কৃষিকাজে ব্যবহৃত জমির পরিমাণ কম। চাষাবাদও হয় প্রাচীন পদ্ধতিতে।
২. উন্নত বীজ, সার এবং কৃষকের অজ্ঞতার অভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় না।
৩. প্রকৃতির বৈরী আচরণে মাঝে মাঝে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ফলে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়।
৪. একই প্রক্রিয়ায় চাষাবাদের ফলে জমির উর্বরতা হ্রাস পায়। এ ছাড়া ত্রটিপূর্ণ বণ্টন ব্যবস্থার কারণে কৃষি জমি ছােট ছােট খণ্ডে ভাগ হয়ে যায়, যা শস্য উৎপাদনের বড় বাধা।
৫. নগরায়ণের ফলে আবাদি জমির পরিমাণ দিন দিন কমে আসছে।
৬. ভূমিহীন কৃষকেরা বর্গাচাষ করে তারা ন্যায্য ফসল পায় না, ফলে উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। কৃষিঝণের অপর্যাপ্ততার ফলেও উৎপাদন ব্যাহত হয়।
৭. মুনাফালােভী অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্যমূল্য বাড়ানাের লক্ষ্যে স্বল্প সময়ের জন্যে খাদ্য মজুদ করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। চোরাচালানের খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। ফলেও
৮. উন্নত দেশগুলাে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্যবাদী নীতির স্বার্থে উন্নয়নশীল দেশগুলােতে খাদ্য সংকট তৈরির জন্যে এক ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ এ ঔপনিবেশবাদী খাদ্য রাজনীতির শিকার।
৯. কীটপতঙ্গের আক্রমণে বাংলাদেশে প্রতিবছর ব্যাপক ফসলহানি ঘটে। অনুন্নত যােগাযােগ ব্যবস্থার কারণেও কখনও কখনও উৎপাদিত ফসল নষ্ট হয়ে যায়।
১০. বাংলাদেশে খাদ্য সংরক্ষণের জন্যে উন্নত ব্যবস্থা নেই। ফলে দীর্ঘ সময়ের জন্যে খাদ্য মজুদ রাখা সম্ভব হয় না।
খাদ্য সমস্যার প্রতিকার: বাংলাদেশে খাদ্যের সংকটের ঘাটতি মেটাতে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে প্রতিবছর খাদ্য আমদানি করতে হয়। এর বিরূপ প্রভাব পড়ে জাতীয় অর্থনীতিতে। উন্নয়ন হয় ব্যাহত। তাই এ ভয়াবহ সমস্যার দ্রুত সমাধানে বেশ কিছু পদক্ষপ নিতে হবে। এগুলাে হলাে:
১. চাষাবাদের জন্যে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার। জনসংখ্যা বৃদ্ধি রােধ এবং নিরক্ষর জনগােষ্ঠীকে এ ব্যাপারে সচেতন করে তােলা অত্যন্ত জরুরি।
২. উন্নত বীজ, সার ও কীটনাশক সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং তাদেরকে হাতেতকলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া।
৩. প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। খাল খনন, নদী খনন ইত্যাদির মাধ্যমে বন্যার সময় অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
৪. একই জমিতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শস্য উৎপাদনের মাধ্যমে জমির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে হবে।
৫. পতিত ও অনাবাদি জমি কৃষিকাজে ব্যবহার করতে হবে। কৃষিখাতে সরকারি বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
৬. সহজ শর্তে কৃষককে ঋণ দিতে হবে। বর্গাচাষীদেরকে উপযুক্ত পাওনা দিলে তারা অধিক উৎপাদনে আগ্রহী হবে।
৭. অসাধু ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারী, মজুতদারদের বিরুদ্ধে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
৮. উন্নত বিশ্বের আধিপত্য থেকে মুক্তি পেতে বাংলাদেশের জনগণকে সুদৃঢ় ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে সংগঠিত হতে হবে।
৯. খাদ্যশস্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর সহজসাধ্য করার জন্যে যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
১০. সুষ্ঠুভাবে খাদ্যশস্য সংরক্ষণের জন্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে গুদাম ও হিমাগার নির্মাণ করতে হবে।
উপসংহার: আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে খাদ্য সমস্যা মানুষের জন্যে এক ভয়াবহ অভিশাপ। এ যেন 'নীরব দুর্ভিক্ষ। তাই খাদ্য সংকটকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। তা নিরসনে সরকারকে সুদৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে সচেতনভাবে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে অর্থনীতি হবে গতিশীল, প্রগতি হবে অবশ্যম্ভাবী।
Post a Comment