SkyIsTheLimit
Bookmark

রচনা যৌতুক: এক অভিশাপ

ভূমিকা : যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি। আমাদের সমাজজীবনে যৌতুক প্রথা একটি অভিশাপ সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্যে যৌতুক প্রথা যে কত ভয়ংকর, তা পত্রিকার পাতা খুললে প্রায়ই চোখে পড়ে। সমাজে ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে যেসব রীতি-নীতি বহুদিন ধরে সমাজে অস্তিত্ব বজায় রেখেছে, তার মধ্যে যৌতুক প্রথা একটি। এ অমানবিক প্রথা নারীর মানবিক অস্তিত্বকে অবমূল্যায়ন করে। যৌতুকের বলি হচ্ছে এদেশের অনেক নারী। যৌতুকের দাবি পরিশােধ করতে না পেরে অনেক নারীজীবনের প্রতি ঘৃণা, বিতৃষ্ণায় আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে। যৌতুকের কারণে ভেঙে গেছে অনেক সুখের সংসার। আমাদের সমাজকে যে কোনাে মূল্যেই হােক যৌতুকমুক্ত করতে হবে। কন্যাকে পাত্রস্থ করার সময় তার অভিভাবক বাধ্য হয়ে পাত্র পক্ষের। চাহিদানুযায়ী যে অর্থ, সম্পদ, অলংকার, আসবাবপত্র ইত্যাদি দিয়ে থাকে। তাকেই যৌতুক বলে অভিহিত করা হয়। অনেক সময় বিয়ের পরও পাত্রপক্ষ অন্যায়ভাবে যৌতুক দাবি করে। এটি একটি নির্যাতনমূলক প্রথা, যা বিয়ের পবিত্রতার প্রতি মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করছে।
যৌতুক প্রথার কারণ : বাংলাদেশের যৌতুক প্রথার কারণ সমাজব্যবস্থার মধ্যে নিহিত। সামাজিক রীতি-নীতি, মূল্যবােধ, অসম বণ্টনব্যবস্থা প্রভৃতির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবেই যৌতুক প্রথা মারাত্মক রূপ ধারণ করছে। যৌতুক প্রথার প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ কারণগুলাে নিম্নে আলােচনা করা হলাে :
১. গণদারিদ্র : যৌতুক প্রথা আমাদের সমাজে অতীতেও ছিল। তখন বর্তমানের ন্যায় গণদারিদ্র্য না থাকায় এটি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হতাে না। বর্তমানেও আমাদের সমাজে ধনী পরিবারের পিতামাতার নিকট যৌতুক আভিজাত্য, শৌখিনতা, আদর, সোহাগ, গৌরব এবং আনন্দের প্রতীক। কিন্তু একটি গরিব পরিবারের কাছে যৌতুক মানে অভিশাপ, অত্যাচার নির্যাতন সর্বোপরি আরও দরিদ্র হওয়া। ২. পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থা ও নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি : পিতৃতান্ত্রিক ও পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থায় নারীদের সামাজিক মর্যাদা ও সম অধিকারের স্বীকৃতি না থাকায় যৌতুক প্রথার মাধ্যমে তা পূরণের হাতিয়ার হিসেবে সমাজে যৌতুক প্রথা বিস্তার লাভ করছে।
৩. আভিজাত্য ও সামাজিক মর্যাদা লাভের আকাঙ্ক্ষা : আর্থসামাজিক পরিবর্তনের ফলে অনেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও বংশ মর্যাদা ও আভিজাত্যের অভাবে সমাজের উঁচু শ্রেণিতে উঠতে পারছে না। এসব ধনীরা অভিজাত শ্রেণিভুক্ত হওয়ার আশায় বিপুল পরিমাণ যৌতুকের বিনিময়ে অভিজাত ও বংশ মর্যাদাসম্পন্ন পরিবারে কন্যাকে বিয়ে দিয়ে থাকে অথবা পুত্রকে বিয়ে করায়।৪. যৌতুক প্রদানের ক্ষেত্রে অর্থহীন অহমিকাবােধ ও অসম প্রতিযােগিতা : ধনী ও নব্যধনী যারা সম্পদের অসম বণ্টন ও দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে রাতারাতি বিত্তবানে পরিণত হয়েছে, তাদের মধ্যে যৌতুক প্রদানের যে প্রতিযােগিতা ও অর্থহীন অহমিকাবােধ রয়েছে তা বাংলাদেশে যৌতুক প্রথাকে তীব্রতর করছে। এসব হঠাৎ ধনী ব্যক্তির জামাই ক্রয়ের প্রতিযােগিতায় যৌতুক প্রথা লালন করছে এবং যৌতুকের দাবিকে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করছে। 
৫. নারীদের পরনির্ভরশীলতা ও নিরাপত্তার অভাব : বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় নারীদের কর্মসংস্থানের সুযােগ না থাকায় তাদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পরনির্ভরশীল জীবনযাপন করতে হয়। ফলে তাদের সামাজিক মর্যাদা নেই বললেই চলে। এমনকী বিয়ের ব্যাপারেও তাদের মতামতের কোনাে মূল্য দেওয়া হচ্ছে না। পরনির্ভরশীল ও মর্যাদাহীন জীবনধারা যৌতুকের প্রবণতা সৃষ্টির অন্যতম সহায়ক।
বস্তুত, দারিদ্র্যপীড়িত এবং আর্থ-সামাজিক বৈষম্যজর্জরিত সমাজব্যবস্থাই যৌতুকের মূল উৎস। নারীসমাজের অর্থনৈতিক পরনির্ভরশীলতা এবং অশিক্ষাই যৌতুকের মূল কারণ। 
যৌতুকবিরােধী আইন ও সামাজিক জনমত : যৌতুক প্রথার বিলুপ্তির জন্যে সরকার যৌতুকবিরােধী আইন প্রণয়ন করেছেন। এরপরও যৌতুকের গতিরােধ করা যাচ্ছে না। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা অনেক সময়  স্বেচ্ছায় যৌতুক দিয়ে যৌতুক প্রথাকে টিকিয়ে রাখতে পরােক্ষ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। তাই যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে সামাজিক জনমত  জোরদার করতে হবে। সামাজিকভাবে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে না পারলে যৌতুক প্রথাকে বিলুপ্ত করা যাবে না। এজন্যে পুরুষকে অর্থলােভ ত্যাগ করে মানবিক ও উদার হতে হবে। নারীকেও হতে হবে যৌতুক বিরােধিতায় দৃঢ়। নারীশিক্ষার ব্যাপক প্রসার এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। 
ধর্মীয় দৃষ্টিতে যৌতুক : যৌতুক সামাজিকভাবেই আইনের দৃষ্টিতে দণ্ডনীয় অপরাধ। ইসলামে যৌতুক নিষিদ্ধ এবং তা হারাম হিসাবে বিবেচিত। যৌতুক প্রসঙ্গে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে দুটি বিষয় বিবেচ্য। প্রথমত এটি একটি অর্থনৈতিক লেনদেন এবং দ্বিতীয়ত এটি বৈববাহিক চুক্তি। লেনদেনের ক্ষেত্রে  ইসলামের নীতিমালা হলাে তা অবৈধভাবে বা অনির্ধারিত পথে অর্জন করা চলবে না। পবিত্র কুরআনে ঘােষণা করা হয়েছে, তােমরা একে অন্যের অর্থ সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কর না। (সূরা বাকারা : ১৮৮)
যৌতুক প্রথা রােধে করণীয় : যৌতুক প্রথার বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলার জন্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলাের প্রতি সংশ্লিষ্ট সকলের মনােযােগী হওয়া দরকার : 
১. যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে; 
২. এর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানাের জন্যে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হবে; 
৩. নারীশিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে; 
৪. ধর্মীয় কুসংস্কার ও স্থানীয় সুবিধাবাদী মহলের বিরুদ্ধে সচেতন মহলকে এগিয়ে আসতে হবে; 
৫. নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে; 
৬. নারীকে উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শনের মতাে যোগ্য করার ব্যবস্থা নিতে হবে; 
৭. যৌতুকবিরােধী আইন প্রায়ােগিক ক্ষেত্রে কতটা মান্য করা হচ্ছে। তা মনিটরিং করতে হবে; 
৮. যৌতুক গ্রহণকারী ও যৌতুক প্রদানকারী উভয়কেই সামাজিকভাবে বয়কট করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে; 
৯. প্রত্যেক ব্যক্তি, প্রত্যেক পরিবার স্ব-উদ্যোগে যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে এ প্রথার বিলুপ্তি সাধনের কাজটি সহজ হবে; 
১০. যৌতুকের কারণে নির্যাতিতদের সামাজিক, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করে অপরাধীর কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করতে হবে;
১১. বিভিন্ন সভা-সেমিনার-এর মাধ্যমে যৌতুকের কুফল সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করতে হবে। 
উপসংহার : নারীসমাজকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে যৌতুক প্রথাকে বিলুপ্ত করতে হবে। নারীকে নিজের ভাগ্য নিজে গড়ার সুযােগ করে দিতে হবে। মেয়েদের জীবিকানির্ভর আর্থিক স্বাধীনতার শিক্ষা দিতে হবে। যৌতুক গ্রহণ ও প্রদান দুটোই দণ্ডনীয় অপরাধ। তবুও যৌতুক প্রথা নির্মূল করা যাচ্ছে না। বিয়ের ব্যাপারে অভিভাবকের লােভাতুর অনুপ্রবেশ যৌতুকের সুযােগ করে দেয়। তবু সবদিক থেকে উদ্যোগ নিলেই যৌতুক প্রথা নির্মূল করা যাবে। তা করতে হলে দরকার পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, সামাজিক প্রতিরােধ, নারীকে শিক্ষা ও মর্যাদাদান এবং যৌতুকবিরােধী আইনের কঠোর প্রয়ােগ। মনের উদারতা আর জীবনমুখী শিক্ষা যৌতুক প্রথা নির্মূলে ইতিবাচক ও ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারে।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment