যােগাযােগ ব্যবস্থার ক্রমবিকাশ: সুপ্রাচীনকালে মানুষ হেঁটে যােগাযােগ রক্ষা করত। ইতালির বিখ্যাত পর্যটক মার্কো পােলাে ভারতবর্ষ, চান এবং প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশসহ প্রায় অর্ধেক পৃথিবী ভ্রমণ করেছিলেন পায়ে হেটে। এরপর শর হলাে ভারবাহী জন্তর পিঠে চড়ে যাতায়াত। যাতায়াতের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয় চাকা এবং যন্ত্রচালিত যান আবিষ্কারের ফলে। স্থল পথে সাইকেল, স্কুটার, মােটরগাড়ি, বাস, রেল, ট্রাক, লরি; নৌপথে নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার, জাহাজ ইত্যাদি; আবার আকাশপথে উড়ােজাহাজের আবিষ্কার মানুষের সময় যেমন বাঁচিয়ে দিয়েছে, তেমনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশকে করেছে, একে অন্যের নিকট প্রতিবেশী। অন্যদিকে ইলেক্টনিক তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর বিপ্লব সারা বিশ্বে গড়ে তুলেছে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশই কোনাে না কোনােভাবে এ নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত।
যােগাযােগের ক্ষেত্রে পরিবহন ব্যবস্থা: বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। তাই বাংলার পরিবহনের ইতিহাস মূলত নৌপরিবহন কেন্দ্রিক। সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নের আগে নৌপথেই যােগাযােগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের মালামাল আনা-নেওয়া হতাে। পর্তুগিজ, ব্রিটিশ, ফরাসি ও আরবরা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে নৌপথেই ভারতবর্ষে আসতেন। পরবর্তীকালে ব্রিটিশদের মাধ্যমেই এদেশে যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়নের সূচনা হয়। ভারতবর্ষে ব্রিটিশরা তাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতিরক্ষা, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক উন্নয়নের প্রয়ােজনে রেলপথ স্থাপন ও রেলগাড়ি চালু করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ রেলওয়ে' নামে পরিবহনের এ খাতটি আধুনিকভাবে পরিবর্তিত ও বিকশিত হয়। বাংলায় সড়ক ব্যবস্থার গােড়াপত্তন হয়েছিল মােগল শাসনামলে সম্রাটদের সামরিক ও বাণিজ্যিক প্রয়ােজনে। উনিশ শতকের শুরুর দিকে সেসবের অধিকাংশই ব্যবহারের অযােগ্য হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ শাসনামলে এবং ব্রিটিশ পরবর্তী পাকিস্তান পর্বে সড়ক ব্যবস্থার কিছুটা অগ্রগতি হলেও স্বাধীনতা পরবর্তী দুই দশকে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। সড়ক যােগাযােগ ব্যবস্থার। চালু হয়েছে আন্তঃজেলা বাস সার্ভিসের পাশাপাশি শহর বাস সার্ভিস, রিকশা, অটোরিকশা, ট্যাক্সি ক্যাব, মিনিবাস, মােটরগাড়ি, জিপ, টাক প্রভৃতি। বেসরকারি খাতের ব্যাপক অংশগ্রহণের কারণে সড়ক ও জনপথের যথেষ্ট সংস্কার ও উন্নয়ন করা হয়েছে। যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে দেশের অভ্যন্তরে এ খাতটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সাম্প্রতিককালে কলকাতার সাথে সড়ক যোগাযােগ চালু হওয়ায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকা গতিশীল হয়েছে আরও এক ধাপ। বাংলাদেশের মােট জলপথের সীমানা ২৪০০০ কিলােমিটার। কোনাে কোনাে এলাকায় নৌপরিবহনই একমাত্র যােগাযােগ ব্যবস্থা। নৌযােগাযােগ ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার, জাহাজ প্রভৃতি। বাংলাদেশের প্রধান দুটি সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ও মংলা। এ বন্দর দটির মাধ্যমে দেশের মােট রপ্তানির ৮০ শতাংশ এবং আমদানির ৯৫ শতাংশ কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। নৌপরিবহন পরিচালনায় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্পোরেশনের অধীনে রয়েছে নৌপরিবহন পুল ও রেজিস্ট্রিকৃত লঞ্চ, স্টিমার ও জাহাজ। দেশের যাত্রী পারাপার ও পণ্য পরিবহনে এ খাত বিশেষ ভূমিকা রাখে। সমুদ্রগামী জাহাজবাণিজ্য সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি খাতে অনুমােদন লাভের পর জাহাজের সংখ্যাও বেড়েছে অনেক। অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্যে যােগাযােগ রক্ষায় জলপথের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলায় প্রথম বিমান চলাচল শুরু হয় সামরিক প্রয়ােজনে। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশ বিমানের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত একটি পুরনাে ডাকোটা ও বিমান বাহিনীর একটি ডিসি-৩ বিমান নিয়ে এর আন্তর্জাতিক যাত্রা শুরু। বর্তমানে বেসরকারিভাবে পরিচালিত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস' নামে এ খাতটি দেশের অভ্যন্তরে ও বহির্বিশ্বে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন করে আসছে।
যােগাযােগের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি: বর্তমান বিশ্বকে চিহ্নিত করা হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রসারের যুগ হিসেবে, যার অন্য নাম বিশ্বায়ন। বিশ্বায়নের ফলে বিশ্বের প্রতিটি মানুষ একটি একীভূত বিশ্বব্যবস্থায় মিলিত হচ্ছে। উপগ্রহ সম্প্রচার প্রযুক্তি, কম্পিউটার ও আধুনিক টেলিযােগাযােগ ব্যবস্থা এ তিনের সমন্বয়ে সারাবিশ্বে দুতগতির এক বিস্তৃত যােগাযােগ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশও এ প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত। বিশ্বায়নের সর্বব্যাপী আক্রমণ বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কিছুটা বিরূপ প্রভাব ফেললেও এর ইতিবাচক দিক হলাে যােগাযােগ ব্যবস্থায় আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সফল ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গতিশীল করা। তথ্যপ্রযুক্তিগত যােগাযােগের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের দেশীয় শিল্প এখন বিশ্ববাজারে স্থান পাচ্ছে। শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে নতুন নতুন ধ্যান-ধারণার অবাধ বিনিময়ের সুযােগ হচ্ছে। বলা যায়, বিশ্ব বাজারে সঠিক মেধার যথার্থ মূল্যায়ন হচ্ছে।
উপসংহার: সভ্যতার শুরুতে মানুষ ঘােড়া, গাধা, হাতি, উট প্রভৃতি জন্তু পােষ মানিয়ে তার পিঠে চড়ে যাতায়াত করত। একসময় এলাে ডুলি, পালকি, চতুর্দোলা। কবুতরের পায়ে চিঠি বেঁধে উড়িয়ে দেয়া হতাে। এরপর প্রচলন হলাে ডাকব্যবস্থার। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে মানুষের প্রয়ােজনে। যােগাযােগ ব্যবস্থায় এসেছে নতুন নতুন পরিবর্তন। যানবাহন ও তথ্যপ্রযুক্তিগত আবিষ্কারের পরিধি হয়েছে উন্নত এবং দুত থেকে দুততর। দেশের দারিদ্র্যসীমা কমিয়ে আনতে, অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গতিশীল করতে যােগাযােগ ব্যবস্থার এ উন্নয়ন বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
Post a Comment