SkyIsTheLimit
Bookmark

রচনা নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য

ভূমিকা : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন 'চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির। অর্থাৎ এমন একটি পরিবেশ, যেখানে মানুষের চিন্তা এবং গুণাবলির যথাযথ বিকাশ ঘটবে। আর এসবের সমন্বয়ে জাতীয় উন্নয়নে আসবে কাঙ্ক্ষিত গতি। আর তা কেবল একটি জাতি-রাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার ও কর্তব্যবােধের সুষম সমন্বয়ের মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে। আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের সুসংঘবদ্ধ নিয়ম ও শৃঙ্খলা বস্তুত বহুমাত্রিক উন্নতি ও সুদূরপ্রসারী অগ্রগতির লক্ষ্যে চালিত। সূচনালগ্ন থেকেই মানুষ সভ্যতার নানা সুযােগ সুবিধা ভােগ করে আসছে। আর সে কারণেই সে সাধ্যমতাে কর্তব্যপরায়ণও হবে। ফলে মানুষ তার সমুন্নত মর্যাদা উপভােগ করার পাশাপাশি সৃজনশীলতা প্রকাশের ও সুযােগ লাভ করবে। এভাবে রাষ্ট্র ও নাগরিকদের পারস্পরিক দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পাদনের মধ্য দিয়ে এক সুখী ও সমৃদ্ধ সমাজ ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটবে। 
নাগরিক কে: সাধারণ ভাষায় নগরে বসবাসকারী মানুষদের নাগরিক বলা হয়। কিন্তু আধুনিক ধারণায় নিজস্ব ঐতিহ্য, ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস, সংস্কৃতি, উৎপাদন ব্যবস্থা সমন্বিত একটি জাতি-রাষ্ট্রের বৈধ বাসিন্দামাত্রই নাগরিক বলে পরিগণিত হন। এক্ষেত্রে জন্মসূত্রে বা আইনের দ্বারা রাষ্ট্র তার অধিবাসিদের নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করে এবং নাগরিক হিসেবে তাদের  অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কেও সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়। কোনাে রাষ্ট্রের লিখিত  বা অলিখিত সংবিধান এবং প্রবর্তিত আইনসমূহ এসব নির্দেশনার ভিত্তিস্বরূপ ‌। 
নাগরিকের গুণাবলি : সহজাতভাবেই মানুষের মাঝে নানা গুণাবলি বিদ্যমান থাকে। বুদ্ধি, বিবেক, আত্মসংযম, জ্ঞান, সচেতনতা, সততা,  ন্যায়বােধ, সৃজনশীলতা ইত্যাদি নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলি হিসেবে বিবেচিত হয়। রাষ্ট্র নীতিগতভাবে এসব গুণের যথাযথ বিকাশ ঘটাতে চায় এবং নাগরিকরাও তাদের গুণাবলির মাধ্যমে রাষ্ট্রের কল্যাণ ও অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
অধিকার ও কর্তব্য : অধিকার ও কর্তব্য এ ধারণা দুটি একে অপরের পরিপূরক। অধিকার আছে বলেই নাগরিকের কিছু কর্তব্যও থাকে। আবার কর্তব্য পালন করার কারণেই নাগরিকদের অধিকার অর্জনের নৈতিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। সাধারণভাবে চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং বিভিন্ন কাজের উপযুক্ত প্রতিদান পাওয়ার নিশ্চয়তাকে অধিকার বলা যায়। আবার এই অধিকারের সীমা, যুক্তি-বুদ্ধি, আইন ও নৈতিকতার নিরীখে নিয়ন্ত্রিত হতে হয় যেন তা অন্য কারাের স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন না করে এবং স্বেচ্ছাচারিতায় পর্যবসিত না হয়। পক্ষান্তরে রাষ্ট্র কর্তৃক পালনীয় দায়িত্ব ও গঠনমূলক কর্মকাণ্ডকে রাষ্ট্রের কর্তব্য বলা যেতে পারে যেগুলো আসলে সমাজ, রাষ্ট্র বা মানবতার কল্যাণে ভূমিকা রাখতে পারে। 
নাগরিক অধিকার : নাগরিক অধিকারের প্রাথমিক ভিত্তি হচ্ছে মানবাধিকার। মানুষ হিসেবে অর্থপূর্ণভাবে বেঁচে থাকা এবং সহজাত মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটানাের যথাযথ সুযােগ লাভ যেকোনাে নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার। আর এসব অধিকার লাভ করার নিরীখে নির্ধারিত হয় নাগরিক অধিকারের পরিধি। বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক লাস্কির মতে, অধিকার হলাে সমাজ জীবনের সেসকল অবস্থা (সুযােগ-সুবিধা) যা ছাড়া মানুষ তার ব্যক্তিত্বকে উপলব্ধি করতে পারে না। সেদিক থেকে দেখলে অধিকারের প্রাপ্যতার মাধ্যমে নাগরিক জীবনের বিকাশ সহজতর হয়। সমাজবিজ্ঞানের আলােচনায় নাগরিক অধিকারকে প্রধানত দু'ভাগে ভাগ করা হয়। যথা নৈতিক অধিকার ও আইনগত অধিকার। 
নৈতিক অধিকার : মানুষের বিবেক ও ন্যায়বােধ থেকে যে অধিকারবােধ জন্ম নেয় তাকে নৈতিক অধিকার বলে। নৈতিক অধিকারের কোনাে আইনগত ভিত্তি নেই। যেমন দুর্বলের সাহায্য লাভের অধিকার নৈতিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। এর কোনাে আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। 
আইনগত অধিকার : রাষ্ট্রের জনগণকে যে সকল সেবা বা অধিকার দিতে রাষ্ট্র বাধ্য থাকে সেটাই নাগরিকের আইনগত অধিকার। আইনগত অধিকারকে আবার তিনভাগে ভাগ করা যায়। যথা ক. সামাজিক অধিকার, খ. রাজনৈতিক অধিকার, গ, অর্থনৈতিক অধিকার। 
সামাজিক অধিকার : সমাজে সুষ্ঠুভাবে জীবন-যাপনের জন্য নাগরিকের যেসব সুযােগ সুবিধা পাওয়ার প্রয়ােজন হয় তাই সামাজিক অধিকার। নাগরিকের সামাজিক অধিকারগুলাে হলাে- জীবনধারণের অধিকার, চলাফেরার অধিকার, সম্পত্তি ভােগের অধিকার, চুক্তি করার অধিকার, ধর্মপালনের অধিকার, পরিবার গঠনের অধিকার, খ্যাতিলাভের অধিকার প্রভৃতি। এসব সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে রাষ্ট্র নাগরিক জীবনের সুষ্ঠু বিকাশে সহায়তা করে থাকে। বিশেষ করে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা ও সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক সংরক্ষিত হয়। এক্ষেত্রেরাষ্ট্রই নাগরিকদের মৌলিক মানবাধিকারের রক্ষাকবচ। মানুষের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে অন্যতম। কোনাে ব্যক্তি, সংঘ, সংগঠন, বহিঃশত্রু বা স্বয়ং রাষ্ট্রকর্তৃক কোনাে নাগরিককে এ অধিকার থেকে বঞিত করা যাবে না; বরং রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাধ্য থাকবে। 
রাজনৈতিক অধিকার : রাজনৈতিক অধিকারের বিস্তৃতির উপর নাগরিকের রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণের বিস্তৃতি বিশেষভাবে নির্ভর করে। রাজনৈতিক অধিকার নাগরিকদের রাষ্ট্রের কাজে অংশগ্রহণের সুযােগ সৃষ্টি করে। যে রাষ্ট্রে রাজনৈতিক অধিকার যত বেশি বিস্তৃত, সে রাষ্ট্রে নাগরিকদের রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণের সুযােগ তত বেশি। একজন নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকারের মধ্যে পড়ে নির্বাচনের অধিকার, কোনাে বিষয়ে আবেদন করার অধিকার, সরকারের সমালােচনা করার অধিকার, বিদেশে অবস্থানকালে নিরাপত্তা লাভের অধিকার, স্থায়ীভাবে বসবাস করার অধিকার ইত্যাদি। এসব অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সুযােগ প্রদান করে। 
অর্থনৈতিক অধিকার : নাগরিক জীবনের, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং উন্নত জীবন-যাপনের জন্য রাষ্ট্র প্রদত্ত অধিকারগুলােই অর্থনৈতিক অধিকার। আরও নির্দিষ্ট করে বললে অর্থনৈতিক অধিকারগুলো হলাে যােগ্যতা - অনুসারে কর্ম প্রাপ্তির অধিকার, ন্যায্য মজুরি লাভের অধিকার, অবকাশ লাভের অধিকার, শ্রমিক সংগঠনের অধিকার প্রভৃতি। অর্থাৎ অর্থনৈতিক অধিকার নাগরিকদের জীবনের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধান করে। এর মাধ্যমে নাগরিকরা নিজেদের উন্নত জীবনের পথে চালিত করতে পারে। 
নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য : রাষ্ট্র যেমন নাগরিকদের বিবিধ সুযােগ সুবিধা এবং অধিকার দিয়ে থাকে তেমনি রাষ্ট্রের প্রতিও নাগরিকদের কতগুলাে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। অধিকার ও কর্তব্য পরস্পর নির্ভরশীল ও পরিপূরক। এক্ষেত্রে নাগরিকদের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে। রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, অখণ্ডতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখার জন্য প্রত্যেক নাগরিককে সর্বদা সজাগ এবং চরম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন এবং সংবিধান মেনে চলা এবং আইনের প্রতি সম্মান দেখানাে নাগরিকদের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। এছাড়া সততা ও সুবিবেচনার সাথে ভােট দেওয়াও নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব। এর ফলে যােগ্য ও উপযুক্ত প্রার্থী জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হবে। তাছাড়া রাষ্ট্রীয় আয়ের প্রধান উৎস নাগরিকদের প্রদেয় কর। তাই নিয়মিত কর ও খাজনা প্রদান করাও নাগরিকের অন্যতম কর্তব্য। রাষ্ট্রের প্রশাসনিক, প্রতিরক্ষা এবং উন্নয়নমূলক কাজ সম্পাদনের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়ােজন। রাষ্ট্রের অর্পিত দায়িত্ব অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে সহায়তা করাও নাগরিকদের কর্তব্য। বস্তুত নাগরিকদের সততা ও নিষ্ঠার ওপর সরকারের সফলতা, উন্নতি ও অগ্রগতি অনেকাংশে নির্ভর করে। তাছাড়া প্রতিটি শিশুই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নাগরিক এবং পিতামাতা তাদের অভিভাবক হিসেবে কাজ করেন। তাই সন্তানদের সার্বিক নিরাপত্তাদান, চাহিদা পূরণ ও সুশিক্ষিত করে তােলা প্রতিটি পিতামাতার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এছাড়া প্রত্যেক নাগরিকের একে অপরকে সহ্য করার মানবাধিকার থাকতে হবে। কেননা ভিন্নমতকে সম্মান করার মধ্য দিয়ে জাতীয় সংহতি অর্জন করা সম্ভব। প্রত্যেককেই এটা বিশ্বাস করতে হবে যে, বৈচিত্র্যের মধ্যেই সৌন্দর্য নিহিত। এছাড়া প্রত্যেক নাগরিককেই দুর্নীতি এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে হবে। এক্ষেত্রে স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের জন্য অহিতকর যেকোনাে কাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানাে নাগরিকদের নৈতিক দায়িত্ব। তবে কোনােক্রমেই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না। এসব বিষয় মেনে চললে রাষ্ট্র উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। 
সংবিধানে নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য : বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকের মৌলিক অধিকারের পূর্ণ নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। একই সাথে রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের কর্তব্য সম্পর্কেও দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে যে, ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলে সমান অধিকার ভােগ করবে। এক্ষেত্রে ধর্ম-বর্ণ বা অন্য কোনাে প্রতিবন্ধকতা নাগরিকের অধিকার আদায়ে বৈষম্যের সৃষ্টি করবে না। এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য অধিকারগুলাে হলাে— আইনের দৃষ্টিতে সমতা, সরকারি নিয়ােগলাভে সুযােগের সমতা, আইনের আশ্রয় লাভের ক্ষেত্রে সম অধিকার, চলাফেরার স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, ধর্ম পালনের স্বাধীনতা ইত্যাদি। সংবিধানের ২০ ও ২১ নম্বর অনুচ্ছেদে নাগরিকদের কর্তব্য পালন সম্পর্কেও বেশকিছু দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। 
উপসংহার : প্রতিযােগিতামূলক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য এবং জাতীয় অগ্রগতি নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতেই হবে। কেননা এর মধ্য দিয়ে নাগরিকবৃন্দ জনসম্পদে পরিণত হয়ে জাতি ও রাষ্ট্রের উন্নতিতে ভূমিকা রাখতে পারবে। একই সাথে প্রত্যেক নাগরিকেরও উচিত মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটানাের পাশাপাশি নাগরিক কর্তব্য সম্পাদনে সচেষ্ট হওয়া। এভাবে অধিকার ও কর্তব্যবােধের যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রত্যাশিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে দেশ। প্রত্যেক নাগরিক যদি নিজেকে রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ বিবেচনা করে কাজ করা যায়, তবেই রাষ্ট্র আত্মনির্ভর হয়ে জনকল্যাণে নিয়ােজিত হতে পারবে ।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment