SkyIsTheLimit
Bookmark

রচনা একুশ শতকের পৃথিবী: আমাদের প্রত্যাশা

ভূমিকা:
বিশ শতকে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির অব্যাহত বিজয় অভিযাত্রা শেষে একুশ শতকে পা রেখেছে পৃথিবীর মানুষ। ক্ষুধা ও দারিদ্র মুক্ত ক্ষেত্রে কী কী বিস্ময় আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে তা যেন স্পষ্টভাবে বলা মুশকিল তেমনি সমাজ জীবনে কী ধরণের পরিবর্তন আসবে তাও অনুমান করা কঠিন। তবু বিশ শতকের অভিজ্ঞতার আলােকে একুশ শতকের পৃথিবীতে আসন্ন পরিবর্তন ও সম্ভাবনা সম্পর্কে একেবারে যে ধারণা করা যায়না তা নয়।
এ শতাব্দীর বড় চ্যালেঞ্জ জনসংখ্যা : একুশ শতাব্দীতে সবচেয়ে সংকটবহুল প্রতিকূল অবস্থার জন্ম দিতে চলেছে বিপুল জনসংখ্যার উদ্বেগজনক বিস্ফোরণ। কারণ এই শতাব্দীতেই বাস্তবায়িত হচ্ছে হিউম্যান পপুলেশনের সর্ব বৃহৎ আকার লাভ। যার ভয়াল রূপ ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। প্রাকৃতিক পরিবেশের বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে। ক্রমাগত দূষণের ফলে প্রতিকূল পারিপার্শ্বিকতায় নানান প্রজাতির বন্য প্রাণীর বিলুপ্তিসাধনের ইঙ্গিতে। বনাঞ্চল ধ্বংস হতে থাকায় উদ্ভিদ জগৎ ও উদ্ভিদনির্ভর জীবের অস্তিত্ব রক্ষার বিপন্নতায়। মানুষ ও প্রাণীকুলের খাদ্যাভাব ও ব্যবহারযােগ্য জল সংকট সৃষ্টিতে। মানুষের নৈতিক আদর্শের অবমূল্যায়ন ও তাদের মানসিক আচরণের বিস্তৃত অবয়বের চেহারা ছবির নমুনা ঘিরে। অ্যাটমােসফিয়ারিক বিজ্ঞানীরা এই বিপুল পরিবর্তনের সম্পর্কসূত্রের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে জনসংখ্যার অতি বৃদ্ধিকেই দায়ী করেছেন মূলত। কারণ পৃথিবীর ইকোলজিক্যাল সাপোের্ট সিস্টেম বিধিবদ্ধ নিয়মকানুন মেনে সুচারুরূপে তখনই ক্রিয়াশীল থাকতে পারে, যখন পারস্পরিক নির্ভরশীলতার অভ্যন্তরীণ প্রয়ােজনে মানবজাতির সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর অন্যসব প্রাণী, উদ্ভিদ জগৎ, জলবায়ু-মাটি ইত্যাদি পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়গুলাে তাদের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রত্যেকের নিজস্ব গণ্ডি থেকে ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়। এই বাস্তব চিত্র আজ একুশ শতাব্দীতে লক্ষযােগ্য, জনসংখ্যার চাপে পৃথিবীর ইকোলজিক্যাল সাপাের্ট সিস্টেম বিধিবদ্ধ ভূমিকা পালন করতে ক্রমান্বয়েই ব্যর্থ হচ্ছে। পরিবেশবিদ ও জীববিজ্ঞানীরা রাশিরাশি তথ্যপ্রমাণ উপস্থিত করে ইতিমধ্যে তাই সরাসরিই জানিয়ে দিয়েছেন, বিপুল জনসংখ্যার প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঠেকাতে না পারলে জগতের অস্থিতিশীলতা প্রতিরােধ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
শিক্ষার মান উন্নয়ন: টেকসই উন্নয়ন অনেকখানিই সুরক্ষিত ও সুষম ইকোসিস্টেমের ওপরে নির্ভর করে গড়ে ওঠে এবং মানুষের মানসম্মত জীবনধারণ ও নিরাপত্তার কথা বলে, যার ফলে একটা সাউন্ড ইকোনমিক্যাল অবস্থা অর্জন সম্ভব হয়। তবে টেকসই উন্নয়নকে এভাবে গুটিকতক উন্নয়নমূলক উপাদানের ওপরে নির্ভর করে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়। একথা গ্যারান্টি দিয়ে হয়ত বলা সম্ভব যে, উন্নয়নকে টিকিয়ে রাখতে শিক্ষার বড় রকমের অবদান সত্যি অনস্বীকার্য। শিক্ষা মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যকে নিশ্চিত করে মানুষকে সমাজের একজন দায়িত্ববান ও উৎপাদনশীল নাগরিক হওয়ার সুযােগ বৃদ্ধি করে। টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে মূল উপাদানটি হলাে মানসম্মত ও সৃজনশীলমূলক শিক্ষা। কাজেই শিক্ষার ধারায় পরিবর্তন আনয়ন, শিক্ষকদের ট্রেনিং প্রদান, কারিকুলাম তৈরিতে দক্ষতা আনয়নসহ অন্যন্য সব দিক পরিকল্পনার আওতায় আনার মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে একটা বিপ্লব আনা যায় যা নিশ্চিত করবে একুশ শতকের শিক্ষার চাহিদা।
বিশ্ব অর্থনীতি: গত পাঁচ বা ছয় দশকে বিশ্বে যতখানি উন্নয়ন হয়েছে, মানব ইতিহাসের আর কোনাে সময় ততটা হয়নি। এই সময়ে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে বিশ্বের সেই সব অংশে, যেগুলােতে শিল্পবিপ্লবের প্রথম দুই শতকের ছোঁয়াই। লাগেনি। আমাদের প্রজন্ম উন্নয়নশীল বিশ্ব বলতে বিশ্বের যে অংশকে চেনে, একুশ শতকে সেই অংশেই আনুপাতিকভাবে সবচেয়ে বেশি বস্তুগত অগ্রগতি হয়েছে। এই অগ্রগতি বহুমাত্রিক: মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু, স্বাস্থ্য ও সাক্ষরজ্ঞান বাড়া, তীব্র দারিদ্র্য ও চরম দুর্দশা আনুপাতিক হারে কমে আসা এই অগ্রগতির প্রধান দিক। অতিসাম্প্রতিক দশকগুলােতে বিস্ময়কর ধারাবাহিকতায় সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকারের উত্থানকে কেন্দ্র করে হইচই, ইউরােপ ও তার আশপাশের দেশগুলাের উপকূলে শরণার্থীদের ভাসমান মৃতদেহের বীভৎস দৃশ্য, সন্ত্রাসবাদের অবিরাম তৎপরতা, দেশে দেশে যুদ্ধ-সংঘাতের ফলে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ-এসব সত্ত্বেও উল্লিখিত মানব উন্নয়নের সূচকগুলার নিরিখে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি অর্জনের বছর হলাে ২০১৭ সাল। এসব সমস্যার মধ্যেও আমাদের এই সময়কাল যে অর্জন ও অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করল, তাকে অস্বীকার করা অসম্ভব। অর্থনীতিবিদেরা সুদীর্ঘকাল ধরে উৎপাদন-সম্ভাব্যতা নিয়ে যে ধারণার ওপর গুরুত্বারােপ করে আসছেন, সেটি হলাে বিদ্যমান সম্পদ ও মেধা দিয়েই সর্বোচ্চ উৎপাদন লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। সমৃদ্ধি ও উৎপাদন-সম্ভাব্যতা রেখা যেটাকে বলা যেতে পারে, বিশ্বের বস্তুগত সমৃদ্ধির ধারা তার অনেক নিচে রয়েছে। তবে আমাদের সমাজগুলােকে আরও সুন্দরভাবে সংগঠিত করে বিদ্যমান জ্ঞান ও মেধার সর্বোচ্চ উৎকর্ষ নিশ্চিত করা যায় এবং অনর্থক সংঘাত এড়ানাে যায়, এমন নীতি গ্রহণ করে সমষ্টিগত সমৃদ্ধি ও এর ক্রমবৃদ্ধি আরও বাড়ানাে যেত। এর সত্যতা প্রমাণ করতে আমাদের এই উপমহাদেশের বাইরে তাকানাের দরকার নেই। দেখা যাবে, এই অঞ্চলের দেশগুলাে নিজেদের মধ্যকার বাণিজ্য সীমিত করে, পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে এবং এক দেশ আরেক দেশের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য অস্ত্রের মজুত বাড়িয়ে সমষ্টিগত সমৃদ্ধির গতি নামিয়ে ফেলেছে।
একবিংশ শতকে গণতন্ত্র: একবিংশ শতকে গণতন্ত্রের রূপবৈচিত্র্য শতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই রূপবৈচিত্র্য এখন গণতন্ত্রকে একটি রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা হিসেবে আর দেখছে না; দেখছে একটি জীবনযাপন পদ্ধতি বা সংস্কৃতির উপাদান হিসেবে। যৌথ জীবনের যেকোনাে ক্ষেত্রে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও মূল্যবােধের চর্চা হিসেবে যদি আমরা গণতন্ত্রকে দেখি, তাহলে রাষ্ট্রবহির্ভূত নানা ধরনের গণতন্ত্রের কথা আমরা ভাবতে পারি। যেমন: রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা), কারখানায় গণতন্ত্র, মহল্লার গণতন্ত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণতন্ত্র, , সামরিক বাহিনীর গণতন্ত্রায়ন ইত্যাদি। গণতন্ত্রের এই রূপভেদের পেছনে সাধারণ যে অনুমান বা সত্যটি কাজ করে তা হচ্ছে, যেকোনাে যৌথ কাজে অংশগ্রহণকারীরা নীতিনির্ধারণ, তা বাস্তবায়ন ও ফলাফল মূল্যায়েন অংশগ্রহণের স্বাভাবিক অধিকার দাবি করতে পারে এবং সেই গণতান্ত্রিক সুযােগ তার থাকাটাই সমীচীন ও ন্যায়সংগত হবে।
মানবিক বিশ্বের প্রত্যাশা: একবিংশ শতাব্দীর মানুষ শােষণ থেকে মুক্তি চায়। মুক্তি মানে মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে সব মানুষ সমান সুযােগ পাবে সে কথাই বােঝানাে হয়েছে। প্রতিটি মানুষের অধিকার আছে পৃথিবীতে সুন্দর ও সুস্থভাবে বাঁচার। প্রতিটি মানুষ তার শ্রম অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় সেবা পাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে এ কথা যত সহজে বলা যাচ্ছে, আদিম সমাজে সেই কথা বলা মােটেই সহজ ছিল না। আদিম মানুষের জীবনযাপন ছিল অনিশ্চিত। সেখানে বন্যপ্রাণীর সঙ্গে বন্যমানুষের সম্পর্ক ও বন্য পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে চলা খুব সহজ কথা ছিল না, এরপর ধীরে ধীরে মানুষ যখন একের পর এক সমস্যায় পড়তে লাগল তখন মানুষ সেসব সমস্যার সমাধানের জন্য চিন্তা করতে লাগল, ফলে পর্যায়ক্রমে মানুষের মগজ-মননের বিকাশ লাভ করল। এই চিন্তার ফলে আদিম মানুষ যাত্রা করে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। আজও মানুষের সেই সমাজ বিকাশের ধারায় সামনে চলার গতি থেমে নেই। মানুষ প্রাকৃতিক নিয়মেই আধ্যাত্মিক, ঐশ্বরিক বিশ্বাস ও সনাতনী প্রথাগতভাবে চলতে অভ্যস্ত। কেননা গতিতেই জীবন। থেমে যাওয়া মানেই পিছিয়ে যাওয়া। মানুষ পেছনে যেতে চায় না। সে সামনে এগােতে চায়। সামনে এগিয়ে যাওয়াই মানুষের স্বপ্ন ও লক্ষ্য। নব-নবআবিষ্কার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিকাশের ফলে মানুষ একের পর এক অবিশ্বাস্য বিজয় অর্জন করেছে। একবিংশ শতকের তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর জীবনে মানুষ প্রয়ােজনে আধ্যাত্মিকতায় মগ্ন হতে চায় কিন্তু সমাজতন্ত্রের গালভরা বুলি শুনতে কেউ ভালবাসে না। বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে, বিশ্ব এগিয়ে যাবে, তবে নতুন বিশ্ব কোন পথে চলবে নতুন দিনের সমাজতাত্ত্বিকদের সেই কথাটাই ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে আবেগকে প্রাধান্য না
দিয়ে যুক্তিকেই মূল্য দিতে হবে। পৃথিবী অতীতে দুটি বিশ্বযুদ্ধ, সমাজতন্ত্র, ধনতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের রক্তাক্ত ইতিহাস প্রত্যক্ষ করেছে, ভবিষ্যতে সমাজতন্ত্রের কাল্পনিক কাব্যকথা শুনতে মানুষ রাজি নয়। পৃথিবীব্যাপী মানুষ আজ এক মানবিক বিশ্বব্যবস্থা ও আইনের শাসন কামনা করছে।
উপসংহার: একুশ শতকের পৃথিবী মানেই বিজ্ঞানের মহা উৎকর্ষের আধুনিক বিশ্ব। যেখানে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন আবিষ্কার চোখ ধাধিয়ে দিচ্ছে বিশ্বের মানুষকে। ফলে মানুষের সার্বিক জীবনমান উন্নত হয়ে চিন্তাধারায়ও এসেছে আমূল পরিবর্তন। এ শতাব্দীর মানুষ তাই আর যুদ্ধ চায় না, তারা চায় একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও নিরাপদ পৃথিবী। যেখানের তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোন আশঙ্কা থাকবেনা, থাকবেনা পরাশক্তির ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রতিযােগিতা। একুশ শতকের বিশ্ব হােক মানবিক বিশ্ব‌।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment