SkyIsTheLimit
Bookmark

বাংলাদেশের উৎসব রচনা

ভূমিকাঃ আভিধানিক ভাবে ‘উৎসব’ কথাটির অর্থ আনন্দজনক অনুষ্ঠান। সম্মিলিতভাবে সাড়ম্বরে কোনাে অনুষ্ঠান করার নামই উৎসব। যে কোনাে উৎসবই মানুষের সাথে মানুষের মিলনের যােগসূত্র তৈরি করে। মানুষের মধ্যে প্রীতির সেতুবন্ধন রচনা করে এই উৎসব। মানুষের মনের ক্লান্তি দূর করে সেখানে অপার আনন্দ আর প্রসন্নতা | সৃষ্টি করতে এই উৎসবের কোনাে বিকল্প নেই। কখন কীভাবে এই উৎসবের উদ্ভব হয়েছিল তা বলা সম্ভব নয়। | তবে এটুকু বলা যায় আদিম মানুষের উৎসবের মূল নিয়ামক ছিল শিকার।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উৎসবকে ব্যক্তি বা পরিবারের সীমায় বেঁধে রাখা যায় না। তার গন্ডে হয় অনেক বড় ও বিস্তৃত। বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যের মাঝে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য উৎসব। যা মধ্যে রয়েছে আনন্দের এক অপার উৎস এবং অনাবিল সুখের ধারা। আর আজকের পৃথিবীতে উৎসবের কোন সীমা পরিসীমা নেই। বিবিধ কারণে দুর্দশাগ্রস্ত বাঙালি জীবনে আনন্দের পরশ নিয়ে আসে বাংলার নানা উৎসব। প্রাচীন ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতির সমৃদ্ধ আননদ ধারা এই বাঙালিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সুখের স্বর্গে। সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত বাঙালির উৎসবে ধর্মানুযায়ী ভিন্নতা ও প্রাচুর্য লক্ষণীয়। পারস্পরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে নিজেকে অভিব্যক্ত করে মানুষ উৎসবের দিনগুলােতে। বাংলাদেশের বিভিন্ন উৎসবগুলােকে কয়েকটি শ্রেণিতে | বিভক্ত করা যায়। বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রকাশ ও অতিথি পরায়ণতার পরিচয় মেলে বিভিন্ন সামাজিক উৎসবগুলাের মাধ্যমে। নানা ধরণের উৎসবগুলাের মধ্যে রয়েছে ঋতুভিত্তিক উৎসব, সামাজিক উৎসব, ধর্মীয় উৎসব, জাতীয় উৎসব, ব্যক্তি কেন্দ্রিক বা পারিবারিক উৎসব ইত্যাদি। | ষড় ঋতুর দেশ বাংলাদেশে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রকৃতিতে নেমে আসে নানা পরিবর্তন। আর এই।

পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নেমে আসে উৎসবের আনন্দ। পুরনাে বছরের দুঃখ, যাতনা, গ্লানি ঝেড়ে ফেলে নতুন। বছরকে স্বাগত জানানাের মধ্য দিয়ে শুরু হয় পহেলা বৈশাখের উৎসব। বাংলাদেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ উৎসবসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উলেস্নখযােগ্য ও বিকাশমান উৎসব হলাে বাংলা নববর্ষ। এ উপলক্ষে নানান অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলা বর্ষবরণ উৎসব গােটা জাতিকে আলােড়িত করে। এছাড়াও রয়েছে ঙচত্র সংক্রান্তি, পহেলা ফাল্গুন, পৌষের পিঠা খাওয়ার উৎসব, শারদীয় উৎসব, বসন্তের দোল খাওয়া উৎসব এবং পাশাপাশি সাংস্কৃতিক উৎসবগুলাের মধ্যে | একুশের বইমেলা, বৈশাখী মেলা, ঢাকার বইমেলা, বাণিজ্যমেলা, রবীন্দ্র-নজরুল জয়মত্মী উৎসব, জাতীয় কবিতা।

উৎসব, রবীন্দ্র সংগীত উৎসব, খাদ্যোৎসব প্রভৃতি আয়ােজন। এ সকল উৎসব থেকে সংস্কৃতিমনা জনগণ আনন্দ ও জ্ঞান দুটোই লাভ করে।বাংলাদেশের সামাজিক উৎসবগুলাের মধ্যে বিবাহই শ্রেষ্ঠ উৎসব। যদিও ধর্মীয় বিধান মতেই সকল সম্প্রদায়ের বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়; তথাপি এতে লৌকিক ও দেশীয় আবহে কোন কমতি দেখা যায় না। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, মানুষ স্বভাবতই আসঙ্গলিঙ্গু। সুতরাং মানুষ সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করবে এটাই স্বাভাবিক। এছাড়া বৌভাতের অনুষ্ঠান, জন্মদিন, আকিকা, বিবাহ বার্ষিকী, জামাইষষ্ঠী, ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, সুন্নতে খাত্না প্রভৃতি উৎসবসমূহ সামাজিক উৎসব হিসেবে চিহ্নিত। এসব উৎসব আমাদের জীবনে বয়ে নিয়ে আসে অনাবিল আনন্দের। বন্যা। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। তাদের ঈদ এ দেশের সবচেয়ে উলেস্নখযােগ্য ও আলােড়িত উৎসব। অনেক সময় যা ধর্ম-গােত্রের সীমা পেরিয়ে সমাজের সকল ধর্মের মানুষের উৎসবে পরিণত হয়। সমাজের | সর্বস্তরের মানুষের একত্র হওয়ার এক অপূর্ব সুযােগ আসে এই দিনে। কারণ আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় উৎসবই সবচাইতে বেশি আনন্দময়। বিশ্বের অন্যান্য মুসলমানদের ন্যায় বাংলাদেশে মানুষও বছরের দুটি ঈদ পালন করে। একমাস সিয়াম সাধনার পর কঠোর সংযমের মধ্য দিয়ে আসে ঈদণ্ডউল-ফিতর। এ উপলক্ষে যাকাত-ফেতরা দেয়ার মাধ্যমে এবং ঈদের নামায শেষে কোলাকুলির মাধ্যমে ধনী-গরিব একই কাতারে সামিল হয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়।

ভােগ নয়, ত্যাগেই মনুষ্যত্ব-এ মহান আদর্শকে সামনে রেখে এবং এ আদর্শে আমাদের উজ্জীবিত করেই প্রতি। | বছর আসে ঈদুল আযহার দিনটি। এ উৎসবের মূলে রয়েছে আত্মত্যাগের এক মহান শিক্ষা। মুসলমানগণ ঐ দিনে। সামর্থ অনুযায়ী পশু কোরবানি করেন এবং অন্যের প্রতি আতিথ্য প্রদর্শন করে অনাবিল সুখের সন্ধান পান। এছাড়াও শবে-বরাত, শবে-কদর, মহররম ইত্যাদি উৎসবগুলােও মুসলমানদের জন্য উলেস্নখযােগ্য। মুসলমানদের পরেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উৎসবের কথা এসে যায়। বছরের প্রতিটি মাসেই তাদের কোন না কোন লৌকিক দেবতার পূজা থাকে। এই সমস্ত ধর্মোৎসবের ভিতরে দুর্গাপূজাই সর্বশ্রেষ্ঠ। তারপর আসে লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা, সরস্বতী পূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা। ঢাক-ঢােল, কাসা-উলুর ধ্বনিতে আন্দোলিত হয়ে উঠে পূজামণ্ডপ।

ফুল, মিষ্টি খাদ্য দ্রব্য অর্ঘ হিসেবে দেয়া হয় দেবীর চরণে। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের উৎসবের মাঝে আছে বৌদ্ধ পূর্ণিমা। প্রবারণী পূজা, মাঘী পূর্ণিমা ইত্যাদি। খ্রিস্টানদের উৎসবগুলাের মাঝে রয়েছে বড়দিন, ইস্টার সানডে, | গুডফ্রাইডে, হেলােইন ইত্যাদি। এ সকল ধর্মীয় প্রধান উৎসবসমূহের মাঝেই মানুষের আনন্দ সবচেয়ে বেশি হয়। জাতীয় চেতনা গঠন, দেশপ্রেমের উৎসব প্রভৃতি আমেজে বাঙালিরা তাদের জাতীয় উৎসবগুলাে পালন করে থাকে। বাঙালি জীবনের অন্যতম প্রধান অংশ হিসেবে গণ্য জাতীয় উৎসবসমূহ। একুশে ফেব্রম্নয়ারি স্বাধীনতা দিবস ও | বিজয় দিবসকে বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে পালন করা হয়। ২৬ মার্চকে স্বাধীনতা ও ১৬ ডিসেম্বরকে বিজয় দিবস | হিসেবে মহাসমারােহে পালন করা হলেও ২১ ফেব্রম্নয়ারিকে পালন করা হয় শােক দিবস হিসেবে। কারণ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারিতে মাতৃভাষার জন্য এদেশের তরুণেরা জীবন দিয়েছিল। একুশের এই শােক উৎসব ও এক ধরণের আনন্দই বয়ে আনে বাঙালির জীবনে। আনন্দ বেদনার এক অভূতপূর্ব সংমিশ্রণে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি জাতি এই দিনগুলােকে জাতীয় উৎসব হিসেবে পালন করে। এর সার্বজনীনতা অন্যান্য উৎসবের চেয়ে অনেক বেশি। পারিবারিক উৎসব একান্তই ব্যক্তির রুচির উপর নির্ভরশীল। এর কোনাে দেশ কাল রূপ নেই। নির্দিষ্ট সময়েও তা করা হয় না। বাংলাদেশে নবজাতকের জন্ম থেকে শুরু করে নানাধরনের পারিবারিক উৎসব পালন করা হয়ে।

থাকে। যেমন- জন্মােৎসব, খাতা, বিয়ে, নবান্ন, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ, পৌষ-পার্বণ ইত্যাদি। এসব পারিবারিক উৎসব মুহূর্তের জন্যে আমাদের জীবনে আনন্দের আবহ নিয়ে আসে। বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে কাজ করতে হয়, আর এই কাজ করতে করতে মানুষ একসময় হাঁপিয়ে ওঠে, তখনই চিত্তে আনন্দ সঞ্চারণের জন্য প্রয়ােজন হয় বিনােদনের আর একটু প্রশান্তির ; যা তার মন থেকে কলান্তি দূর করে আবার পূর্ণোদ্যমে কাজ করার শক্তি যােগায়। এছাড়া সমাজ ও জাতীয় জীবনে কিছু কিছু উৎসব পালনেও বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এসব উৎসব মানুষের নৈতিক দায়িত্ববােধ জাগ্রত করে। এসব জাতীয় উৎসব দেশপ্রেমের অনুপ্রেরণা জোগায় এবং মনে আনন্দ উৎসারিত করে। উৎসবই সেই আনন্দ দেয় ও চিত্তের ক্ষুধা নিবারণ করে। সুতরাং মানুষের ব্যক্তিজীবন ও জাতীয় জীবনে উৎসবের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের এই সবুজ শ্যামল দেশ, গানের দেশ, প্রাণের দেশ, উৎসবের দেশ। মানুষের ঝিমিয়ে পড়া জীবন যেন নতুন প্রাণ ফিরে পায় উৎসবের পরশে। আর সে জন্যই চিত্তে প্রসন্নতার জন্য প্রয়ােজন উৎসবের। উৎসব মানুষকে সাময়িকের জন্য হলেও সংসারের নানাবিধ দুঃখ, যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়। একটানা কর্মজীবনের একঘেয়েমি, অবসাদ, গ্লানি দূরীভূত করে নতুন জীবন দান করে। উৎসবের দিনগুলােতে মানুষ যদি মন প্রাণ দিয়ে আনন্দের সাথে উৎসব পালন করে, তাহলে উৎসবের আনন্দ তার মাঝে বহুদিন পর্যন্ত বিরাজ করে। বাঙালির উৎসব বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক, তাই এগুলােকে আমাদের যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা উচিত। কারণ উৎসব ব্যক্তিজীবন ও সমাজ জীবনে মহাকল্যাণ সাধন করে। উৎসবের মধ্যে নিহিত রয়েছে বাঙালির প্রাণের আকুতি, তার জীবনবােধ, স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণপ্রবাহ।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment